আনিসুল হকের কলাম

মেষশাবকেরা নেকড়ের উপদেশ কেন শুনবে

পৃথিবীব্যাপী আদর্শের এই রকম অবনমন একবিংশ শতাব্দীতে ঘটছে, বিশ্বাস করা মুশকিল। প্রথম আলোয় ২২ জানুয়ারি ভারতীয় কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রনীতি-বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ সরণের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতি’।

এই লেখায় গণতন্ত্র বিষয়ে পশ্চিমাদের অবস্থান নিয়ে তিনি লেখেন, ‘যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, তা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এবং দেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত একটি সরকারকাঠামো। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে চীন ও রাশিয়ার কথা। তারা যে গণতন্ত্রের দাবি করে, তা পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ইরানের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ইতিহাস রয়েছে। তবে ইরানের শাহের সঙ্গে কাজ করে পশ্চিমারা যে স্বাচ্ছন্দ্য পেত, তা হারানোর অসন্তোষ তাদের এখনো আছে। ইরানে বর্তমানের নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে ফলাফল আসছে, তা-ও পশ্চিমাদের পছন্দ নয়।

‘মিসরে একমাত্র অবাধ ও সুষ্ঠু যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে মুসলিম ব্রাদারহুড জয় পেয়েছিল। তবে পশ্চিমাদের যোগসাজশে সেই দেশে দ্রুতই গণতন্ত্রকে দমন করা হয়। তখন থেকেই মিসর সামরিক একনায়কতন্ত্রের দিকে ফিরে গেছে, যারা পশ্চিমাদের প্রতি বন্ধুত্বসুলভ। বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের “গণতন্ত্রের” উদাহরণ রয়েছে।’

পঙ্কজ সরণের তালিকার সঙ্গে আরও অনেকগুলো দেশের নাম আমরা যুক্ত করে দিতে পারি! পাকিস্তানে এখন কী হচ্ছে? ইমরান খান কোন গণতান্ত্রিক, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের নিক্তিতে তুল্য হচ্ছেন।

ভারতে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের, মহাত্মা গান্ধী থেকে জওহরলাল নেহরু ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের শক্ত বেদির ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সেখানে নিশ্চয়ই ভোটের দিন ভোটাররাই ভোট দেন এবং সেই ভোট গণনা করা হয়। কিন্তু আপনি হিন্দুত্বের জিগির তুলে ভোটের মাঠে জোয়ার সৃষ্টি করবেন, ভোটে জিতবেন, তখন সংখ্যালঘু মানুষের মনের মধ্যে কোন ঝড় বইছে, সেটা কে অনুভব করবে? ধর্মনিরপেক্ষতাই-বা কোথায় যাবে?

পৃথিবীর মানুষেরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছিল—পৃথিবীর সব মানুষ সমান।জাতিসংঘের সনদের প্রথম লাইনই তা—অল হিউম্যান বিইংস আর বর্ন ফ্রি অ্যান্ড ইকুয়াল ইন ডিগনিটি অ্যান্ড রাইটস। দে আর ইনডাউড উইথ রিজন অ্যান্ড কনশেন্স অ্যান্ড শুড অ্যাক্ট টুওয়ার্ডস ওয়ান অ্যানাদার ইন আ স্পিরিট অব ব্রাদারহুড।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের মর্যাদা আর অধিকার সমান। কিন্তু পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই সরকার গঠনে, সরকার পরিচালনায়, নীতি প্রণয়নে সাধারণ মানুষদের কোনো ভূমিকা থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা গণতন্ত্রের অগ্রপথিক বলে যদি ধরে নিই, সেখানে কি কালো মানুষদের, গরিব মানুষদের, হিস্পানিকদের, নানা রঙের অভিবাসী আমেরিকান নাগরিকদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে? তারা কি শাসক বাছাইয়ে কোনো ভূমিকা রাখে?

নির্বাচিত শাসকেরা কি প্রান্তিক মানুষদের ভাগ্যোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে! নোম চমস্কি হোয়াট কাইন্ড অব ক্রিচারস আর উই বইয়ের একটা অধ্যায়ে এই প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। নিচে আমি তাঁর বইয়ের ‘হোয়াট ইজ দ্য কমন গুড’ ধরে খানিকটা নিজের সঙ্গে যুঝব।

অ্যারিস্টটল প্রায় ২ হাজার ৪০০ বছর আগে বলে গেছেন, যত ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালো যদি না-ও হয়, তাহলে সবচেয়ে কম খারাপ। তবে তিনি গণতন্ত্রের একটা ত্রুটি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তা হলো, গরিব মানুষেরা সংখ্যায় বেশি, তারা ভোট দিয়ে ধনীদের সম্পদ কেড়ে নিতে পারে, যা অন্যায্য হবে। জেমস ম্যাডিসন, উনিশ শতকের চিন্তাবিদও একই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তবে অ্যারিস্টটল সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন, বৈষম্য কমাতে হবে। আর ম্যাডিসনের সমাধান ছিল, গণতন্ত্র কমাতে হবে।

সতেরো শতকে যখন ইংল্যান্ডে রাজা আর পার্লামেন্টের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ভদ্রলোকেরা নিজেদের সাধারণ মানুষদের বানানো আইনকানুন দ্বারা শাসিত হতে চাননি। বিপরীতে সাধারণ মানুষদের প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘নাইটগণ এবং ভদ্রলোকেরা যখন আইন বানায়, তা বানায় আমাদের শোষণ করার জন্য, তারা জনগণের ক্ষত বোঝে না।’

নোম চমস্কি বলছেন, প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন, তিনি দুটো ভাগ করেছেন, অভিজাততন্ত্রী ও গণতন্ত্রী। সাধারণ মানুষ, গরিব, অশিক্ষিত মানুষ শাসনের এখতিয়ার পাবে, অভিজাততন্ত্রীরা এই ধারণাকে ভয় পায়। এখনো দেশে দেশে অভিজাততন্ত্রীদের গণতন্ত্রই কায়েম হয়ে আছে। তারা একমত যে ধনবানেরা, ক্ষমতাবানেরা, অভিজাতরা, বনেদিরাই রাষ্ট্র চালাবে; তবে তাদের মধ্যে এখনকার তর্কটা হলো, অভিজাতদের কোন অংশ?

নীতিবিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবী, টেকনোক্র্যাট, জ্ঞানীসমাজ, নাকি ব্যাংকার, করপোরেট এক্সিকিউটিভ? নাকি পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি, নাকি আমলাদের সংঘ? চমস্কি বলছেন, এ হলো রাজনৈতিক মুরুব্বিগিরি, উদারবাদ যার অবসান চায়। এই উদারবাদ ইন্ডাস্ট্রিকে সামন্তবাদী থেকে গণতান্ত্রিক সমাজ বানানোর প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে চায়। এ জন্য যারা উৎপাদন করে, তাদের সম্মান নিশ্চিত করে, শ্রমিকদের কর্তৃত্ব বাড়াতে চায়, যাতে তারা অন্যের হাতের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।

২০০ বছর আগে আন্দোলনরত হাজার হাজার শ্রমিকের ওপরে ব্রিটিশ অশ্বারোহীরা আক্রমণ করলে প্রতিবাদে কবি শেলি একটা কবিতা লিখেছিলেন।
কাজ করো, এবং এ রকম মজুরি পাও,
কোনোরকমে দিন গুজরান করে যাও,
হামাগুড়ি দিয়ে, তোমার খাঁচায়,
স্বৈরশাসকদের জন্য, খেটে যাও,
...
করো ওই খাঁচায় বসবাস
তুমি হও আত্মায় ক্রীতদাস
তোমার নিজের ইচ্ছার ওপরে তোমার নেই কোনো দাবি
অন্যের ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা, তোমার চাবি।

আগে শ্রমিকেরা, কৃষকেরা, তাঁতিরা, কুটির শিল্পের লোকেরা যা বানাত, তা বিক্রি করত। আজকের দিনে শ্রমিকেরা নিজেদেরই বিক্রি করে দেয়। ১০০ বছর আগের বোস্টনের পোশাকের নারী শ্রমিকদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই বাংলাদেশের গার্মেন্টসশ্রমিকদের। সারা দিন পরিশ্রম, তারপর ঘুম। আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!

যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, কম বুদ্ধির বহিরাগতদের বাইরেই রাখতে হবে, বুদ্ধিমান সংখ্যালঘুরা দেশ চালাবে। ‘ট্রুম্যান অল্পসংখ্যক ওয়ালস্ট্রিট আইনবিদ এবং ব্যাংকার দিয়ে দেশ চালিয়েছিলেন’—সেভাবে দেশ চালাতে হবে।

তবুও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভোট দেয় এবং ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করবে, যারা তাদের শোষণ করে। ভারতের মানুষ ভোট দেয় এবং উন্মাদনার ভোটে মাইনরিটির বেদনা উড়ে যায়। বাংলাদেশে আমরা ভোট দিই বা না দিই, শাসক আগে থেকে ঠিক করা থাকে এবং শাসকেরা ঠিক করে দেন, বিরোধী কারা হবেন।

চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। অনেক উন্নত দেশেই চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। যুক্তরাষ্ট্রে এটা হতে পারল না। হতে পারে না, কারণ কায়েমি ব্যবস্থা এটা ভাঙতে দিতে চায় না। ৮৫ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাব্যবস্থার বদল চায়, তা-ও জন কেরি এই উদ্যোগ পরিহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ৬০ শতাংশ লোক পরিবর্তন চাচ্ছিল, ওবামা তা করতে পারেননি। কারণটা কী? কারণটা গণতান্ত্রিক নয়। কারণটা হলো বড়লোকদের স্বার্থ, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ।

চমস্কি উদ্ধৃতি দিয়েছেন জন ডিউয়েকে। তিনি বলছেন, ‘আজকের দিনে ক্ষমতা তার হাতে, যে উৎপাদন, এক্সচেঞ্জ, প্রচারযন্ত্র, পরিবহনব্যবস্থা, এবং যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা এগুলোর মালিক, তারা দেশের জীবনকে শাসন করে।’ তিনি এর অবসানের কথা বলেছেন।

এটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আর যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তকদের কথা হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে আমরা কী বলব? আমাদের ৬৫ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী, বড় বড় শিল্পকারখানা-ব্যবসা, গণমাধ্যম, ব্যাংক ইত্যাদির মালিক। তাঁরা দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকে কী দেবেন?

তবুও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভোট দেয় এবং ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করবে, যারা তাদের শোষণ করে। ভারতের মানুষ ভোট দেয় এবং উন্মাদনার ভোটে মাইনরিটির বেদনা উড়ে যায়। বাংলাদেশে আমরা ভোট দিই বা না দিই, শাসক আগে থেকে ঠিক করা থাকে এবং শাসকেরা ঠিক করে দেন, বিরোধী কারা হবেন।

এই পর্যন্ত ভাবতে পারলাম। ভেবে দুঃখে মুষড়ে পড়ছি। কিন্তু যখন ভাবি, ইসরায়েলে, গাজায়, ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে? ওখানে কি মানবাধিকার বলতে কিছু আছে? কেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমাদের এত মেলামেশা? তখন একটা উপসংহারে আসি, পৃথিবীতে ন্যায্যতা বলে কিছু নাই। এবং পশ্চিমাদের কাছ থেকে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের সবক শোনা মেষশাবককে নেকড়ের দেওয়া উপদেশের মতোই।

এই পৃথিবীর ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। কে সাজাবে, কীভাবে সাজাবে, তা জানি না। তবে আমরা, সারা পৃথিবীর মানুষই হয়তো বড় একটা আদর্শিক শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক