কোনো বিষয়ের স্বল্পকালীনতার প্রতীক হিসেবে পশ্চিমে ‘লেটুসপাতা’র সতেজ ও সজীব থাকার সময়কালকে তুলনা করা হয়। একই উপমা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ‘কচুপাতার পানি’, ‘পদ্মপাতায় জল’ বা ‘ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু’ প্রভৃতি শব্দবন্ধে বোঝানো হয়। ইতিহাসের স্বল্পতম সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ক্ষমতার যবনিকা কত দ্রুত ঘটতে যাচ্ছে, তার ক্ষণগণনায় ‘লেটুস’ প্রতীকটি সবার নজর কাড়ে।
খেত থেকে তুলে আনা একটি লেটুস হয়তো ৯ থেকে ১০ দিন সময় পর্যন্ত রেফ্রিজারেটেড শেলফে তার সজীবতা ধরে রাখতে পারে। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের জোকটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দ্য স্টার একটি ভিডিওর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচার করতে থাকে। কীভাবে লেটুস ধীরে ধীরে প্রাণরস শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তা সবাই দেখে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই লিজ ট্রাসের সময় শেষ হয়ে যায়, লেটুস তখনো পুরোপুরি শুকায়নি।
বাংলার কচুপাতায় জমা হওয়া কয় ফোঁটা বৃষ্টির পানি, পদ্মপাতার জল বা ঘাসের ডগার শিশিরবিন্দু তারও কম অনিশ্চিত সময়ে ঝরে পড়ে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অনিশ্চয়তার একটি দার্শনিক সত্য হয়তো প্রকৃতির একটি সহজ ও ছোট্ট উপমায় এখানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো।
ব্রিটিশ রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি স্মরণাতীত কালের ছবি হয়ে থাকবে ৭০ বছর সিংহাসনে সমাসীন দীর্ঘজীবী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে ৪৫ দিনের ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের বালমোরাল প্রাসাদে করমর্দন। রানির মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে এ ছবি নেওয়া হয় এবং জীবদ্দশায় রানির সর্বশেষ প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ছবি হিসেবে এটি ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। ব্রেক্সিট নেতা বরিস জনসনের ঝড়ের গতিতে আবির্ভাব ও লেটুসের মতোই স্বল্প সময়ে বিবর্ণ প্রস্থান আরও নাটকীয়। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও নিজ দলীয় সদস্যদের ব্যাপক অনাস্থায় তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। এ অনাস্থার প্রধান কারণ ছিল ‘নৈতিকতার মানদণ্ডে’র সীমা লঙ্ঘন।
শ্রীলঙ্কার শাসকদের ভঙ্গুরতা আরও ব্যাপক ও ভয়ানক। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ১৯৭০ সাল থেকে পার্লামেন্টের সদস্য, মন্ত্রী, স্বল্প-দীর্ঘ যা–ই হোক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, একবার বিরোধী দলের নেতা, কত কিছু! চলতি বছরের মে মাসের ৯ তারিখ পদত্যাগ করে পরদিনই সপরিবার পালিয়ে যান ত্রিঙ্কোমালি।
তাঁরই ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড—এসব দেশে সাময়িক ভিসায় অবস্থান করে ৫২ দিনের মাথায় দেশে ফিরে এখন তিনি সরকারি নিরাপত্তায় আছেন। মাহিন্দার আরও তিন ভাই এবং অনেক আত্মীয়কে নানা রাষ্ট্রীয় পদে বসানো হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে, শ্রীলঙ্কার বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ রাজাপক্ষে পরিবারের কবজায় ছিল। এখন কচুপাতার পানির মতো ঝরে পড়া শুধু নয়, দেশটাকেও তারা লেটুস নয়, তেজপাতা বানিয়ে রেখে গেছে।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে লেটুসপাতা নির্জীব হওয়ার উপমা যথার্থ। ধীরে ধীরে রস কমতে থাকা ও রং বিবর্ণ হওয়া সবই দৃশ্যমান। এটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত অস্থিরতার মীমাংসা একটি ধরন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে স্থিতিশীল ও দৃশ্যমান কোনো গতিপথ নেই। কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করাও দুরূহ।
আর এক টালমাটাল রাজনীতি ও ক্ষমতার কচুপাতার পানির অস্থিরতায় আক্রান্ত চির অস্থির পাকিস্তান। সাড়ে তিন বছরের মাথায় ৩৪২ সদস্যের পার্লামেন্টের মাত্র ৫ শতাংশ জোটসঙ্গীর পক্ষত্যাগে পিটিআইয়ের নেতৃত্বাধীন ইমরান সরকারের পতন হয়। তারও ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন ‘তোষাখানা তছরুপ’সংক্রান্ত অভিযোগে ইমরানকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করল। অনেক বিদগ্ধজন মনে করতেন, সামনে যখনই নির্বাচন হোক, ইমরান বর্ধিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। ইতিমধ্যে উপনির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল তা প্রমাণও করেছেন।
সে ফেরার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতেই হয়তো এ মামলার প্রচেষ্টা। যে সময় তোষাখানার কতিপয় উপহার নামমাত্র মূল্যে কিনে বাজারে তা বিক্রি করা এবং তার তথ্য গোপনের অভিযোগে ইমরান অভিযুক্ত ও দণ্ডিত; একই সময়ে গদিনশিন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দুই পুত্রের ১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন রুপি বিদেশে পাচারের মামলা প্রত্যাহার করা হলো। বর্তমান (২০২২) প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তঁার দুই পুত্র হামজা ও সলেমান মিলে এ রুপি ২৪টি ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৮-২০১৮ সময়ের মধ্যে বিদেশে পাচার করেন, এ মর্মে পাকিস্তান ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ২০২০–এ একটি মামলা করে। মামলার পর সুলেমান বিদেশ পাড়ি জমান।
যেসব অভিযোগে ইমরান সরকার পদচ্যুত হন, সেই একই অভিযোগ আরও গুরুতর হয়ে এখন শাহবাজ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে। পাকিস্তানে এখন উচ্চ হারের মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যসহ সব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার–সংকট চরমে। ক্ষমতা ছাড়ার পর ২৭ মার্চ এক জনসভায় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুতির ফাঁদ পাতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে ইমরান খান এক ভাষণ দেন। তবে একটি শক্তিশালী মত হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধই জনাব খানের পতন ত্বরান্বিত করেছে। তবে নভেম্বরে (২০২২) বর্তমান সেনাপ্রধান পরিবর্তিত হবে। পাকিস্তানের সামনের নির্বাচন সেনাবাহিনী, নির্বাচন কমিশন এবং উচ্চ আদালতের ভূমিকার ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক অবস্থা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না। সাংঘর্ষিক রাজনীতির ধারাবাহিকতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় করে যে রাজনীতির ক্ষমতাশ্রয়ী ধারা, তা অব্যাহতভাবে বিকাশমান। ২০২৩–এর শেষে যে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচন তার মধ্যখানের একটি বছরে কী হয়, তা কারও বোধগম্যতার আওতায় নেই।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে লেটুসপাতা নির্জীব হওয়ার উপমা যথার্থ। ধীরে ধীরে রস কমতে থাকা ও রং বিবর্ণ হওয়া সবই দৃশ্যমান। এটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত অস্থিরতার মীমাংসা একটি ধরন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে স্থিতিশীল ও দৃশ্যমান কোনো গতিপথ নেই। কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করাও দুরূহ।
তাই এ দেশীয় মাটি উৎসারিত ও মানুষের মুখে যে উপমা তা এখানকার জন্য উপযুক্তই বটে। পিচ্ছিল ও মসৃণ পদ্মপাতা বা কচুপাতার টলটলে জল কখন নিমেষে পড়ে যায়, তা বলা যায় না। এই হঠাৎ পড়ে যাওয়াটা খুবই অমসৃণ ও বেদনাদায়ক। আমরা এ অবস্থার অবসান চাই। একটি স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ক্ষমতার মীমাংসা চাই।
ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ
tofail101@gmail.com