ভারতের এক স্পর্শকাতর অংশ পাঞ্জাব। এ রাজ্যে আবারও তুমুল উত্তেজনা ছড়াল সম্প্রতি। অনেক দিন শান্ত থাকার পর ‘বিচ্ছিন্নতা’র আলামতে শিখরাজ্য সরব। সরকার রাজ্যটিতে ১৮ মার্চ থেকে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দিয়ে বিশেষ অভিযানে নেমেছে। ধরপাকড় চলছে ব্যাপক।
পাঞ্জাবের এবারের উত্তেজনার ভরকেন্দ্রে আছে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ (পাঞ্জাবের উত্তরাধিকার) নামের একটা সংগঠন ও তার সংগঠক অমৃতপাল সিং। মাত্র ২৯ বয়সী এক স্বঘোষিত শিখ ‘স্বাধীনতাবাদী’ তিনি। অমৃতসরের সন্তান অমৃতপাল একসময় দুবাইয়ে গাড়ি চালাতেন। এক বছর ধরে অনলাইনে পুরোনো খালিস্তান আন্দোলনের স্মৃতি জাগিয়ে তুলে আলোচনায় আসতে থাকেন তিনি। এ নিয়ে হঠাৎ ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে বিরূপ সমালোচনা শুরু হয়। যদিও তিনি বক্তব্যে অহিংসার কথাই বলছিলেন, কিন্তু দ্রুত তাঁকে ঘিরে ভয়ের একটা আবহ ছড়ানো শুরু হওয়ামাত্র ভারত সরকার অমৃতপালকে খুঁজতে শুরু করে। তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে সমাজে ‘শক্তি প্রয়োগে’র অভিযোগ উঠে আসে। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় তাঁকে।
এদিকে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’র আইনজীবী ইমান সিং বলছেন, অমৃতপালকে সরকার ইতিমধ্যে আটক করেছে। এখন পলাতক দেখিয়ে হয়তো ‘এনকাউন্টারে তাঁর অন্য ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে।’ তাঁর এ রকম দাবি এই ইস্যুতে বাড়তি উত্তেজনা ছড়িয়েছে। অমৃতপালের নিরাপত্তা চেয়ে ইমান সিং ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের আলোকে পাঞ্জাব হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন। বিজেপি অবশ্য পুরো ঘটনায় পাকিস্তানের ইন্ধন রয়েছে বলে জনগণকে বোঝাচ্ছে।
অমৃতপাল দেখতে একদম পাঞ্জাবের পুরোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ জার্নাল সিং ভিন্দ্রওয়ালের মতো। ১৯৮৪ সালে যে শিখ জাতীয়তাবাদী স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সামরিক সংঘাতে নিহত হন। পাঞ্জাবের গ্রামীণ সমাজে ভিন্দ্রওয়ালে ভীষণ জনপ্রিয় এখনো। তাঁকে ‘শহীদ’ হিসেবেই গণ্য করা হয় সেখানে। ঠিক হুবহু তাঁর মতো দেখতে হওয়ায় অমৃতপাল রাজনৈতিক কথাবার্তা বলামাত্র পুরো রাজ্যের মনোযোগ কেড়ে নেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রয়াত ভিন্দ্রওয়ালের গ্রামেই অমৃতপালের ‘দস্তরবন্দি’ (পাগড়ি পরানো) অনুষ্ঠান হয়েছিল।
শিখ ঐতিহ্য অনুযায়ী অমৃতপাল ‘কৃপাণ’ও বহন করতেন। তাঁর প্রতিটি কাজ মিডিয়ায় ব্যাপক মনোযোগ পাওয়ার ঠিক বিপরীত দিকে তাঁকে ঘিরে ভারতের অন্যত্র অ-শিখদের মধ্যে নেতিবাচক প্রচারও পরিকল্পিতভাবে বাড়তি গতি পায়। এ রকম পটভূমিতেই তাঁর সঙ্গী-সাথিদের তুমুল বেগে আটক অভিযান চলছে এখন। সরকারি হিসাবে ইতিমধ্যে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ সংগঠন এবং অমৃতপালের ১১২ অনুসারীকে আটক করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি।
চলতি এ অবস্থায় পাঞ্জাবের জনমানসে পুরোনো সহিংস দিনগুলোর কিছুটা ছায়া পড়েছে আবার। দেশে-বিদেশের শিখ-সমাজেও উত্তেজনার মৃদু লহর বইছে হঠাৎ করে। এ সপ্তাহেই যুক্তরাজ্যে ভারতীয় দূতাবাস শিখদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আক্রমণকারীদের হাতে ছিল শিখদের কল্পিত রাষ্ট্র ‘খালিস্তানের’ পতাকা। এরপর থেকে সেখানে ভারতীয় দূতাবাসকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
পৃথক ‘আবাসভূমি’র আলাপ শিখ রাজনীতিতে পুরোনো এবং সহিংস এক প্রসঙ্গ। অমৃতপাল নতুন করে সেটা আলোচনায় আনার পাশাপাশি চণ্ডীগড়ের ওপর পাঞ্জাবের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন এবং রাজ্যের পানি অধিকারের বিষয়গুলোও তুলে ধরছিলেন। তিনি বিশেষভাবে জোর দিচ্ছিলেন পাঞ্জাবের সমাজকে মাদকমুক্ত করার ওপর। ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ সংগঠনের স্বঘোষিত প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত একটা উক্তি হলো: ‘আমি সংবিধানে ততটুকুই আস্থাশীল সেখানে যতটুকু পরিমাণে আমার পরিচয় সংরক্ষিত থাকবে; আমি পাঞ্জাবি।’
শিখ জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় ও জাতিগত ঐতিহ্যের জায়গা থেকে একত্র করার ডাক দিয়ে মাঠে নামেন তিনি মূলত কয়েক মাস হলো। যেসব শিখ অন্য ধর্মে চলে গেছে, তাদেরও ‘ঘরে’ ফেরার ডাক দেন। তাঁর এসব কাজে শিখ–সমাজে তুমুল আলোড়ন ওঠে এবং শিখ তরুণেরা দলে দলে তাঁর চারপাশে জড়ো হচ্ছিল কিছুদিন ধরে।
ভারতের প্রধান দুই জাতীয় দল বিজেপি ও কংগ্রেস কেউই পাঞ্জাবে সবল নয়। এ রাজ্য শাসন করছে আম আদমি পার্টি। অমৃতপালের উত্থানে স্বাভাবিকভাবেই তারা রাজনৈতিক আধিপত্য হারানোর শঙ্কায় পড়ে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর অভিযানে তাদের ইতিবাচক মনোভাব ছিল। অমৃতপালের বিরুদ্ধে অভিযাগ শুরু হওয়ামাত্র এএপি দলের নেতৃত্ব সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কংগ্রেস বলছে তারা ‘শান্তি’ চায়। অর্থাৎ এ রকম অভিযানে তাদেরও নীরব সায় আছে। পুরোনো ও প্রথাগত শিখ সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে না বললেও এটা বোঝা যায়, অমৃতপাল কোণঠাসা হলে তারাও স্বস্তি বোধ করবে।
নতুন এই জাতীয়তাবাদী তারকার উদয়ে নিজ নিজ কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে পড়েছিল এসব সংগঠন। চারপাশের এ রকম বিরূপ পরিস্থিতির ফল হিসেবে অমৃতপাল এখন আত্মগোপনে গেছেন। পাঞ্জাব–সংলগ্ন পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় রক্ষীরা কড়া নজরদারিতে নেমেছেন নতুন এই শিখ নেতা যাতে কোনোভাবে পালাতে না পারে। নেপালকেও সতর্ক করা হয়েছে—যাতে ওদিকে যেতে না পারেন তিনি।
এদিকে ‘কওমি ইনসাফ মোর্চা’ নামের শিখদের একটা সামাজিক সংগঠন অমৃতপালবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। মোর্চা বলছে, তারা এই ‘অন্যায়ে’র প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে। সংগঠনটি বহুদিন ধরে শিখ রাজবন্দীদের মুক্তির আন্দোলন করছে। রাজনীতিসচেতন শিখ–সমাজে তাদের ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে, বিশেষ করে মোহালি অঞ্চলে। উল্লেখ্য, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ অভিযোগে অনেক শিখ রাজনৈতিক কর্মী দীর্ঘকাল ধরে কারাগারে আছেন।
অমৃতপাল সিংয়ের চলতি ঘটনাবলির আগে ২০২০-২১ সালে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বড় ধরনের এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকেরা। কৃষক স্বার্থবিরোধী কয়েকটি আইনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে শিখ কৃষকেরা শুরু করলেও পরে সেই আন্দোলন ভারতজুড়ে তীব্র আলোড়ন তোলে। তবে দাবির প্রশ্নে ওই আন্দোলন সরকার থেকে সবকিছু অর্জন করতে পারেনি। ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের কেউ কেউ মনে করছেন শিখ–সমাজের গভীরে থাকা অতি পুরোনো ‘বিছিন্নতাবোধে’রই বহিঃপ্রকাশ এসব আন্দোলন-সংগ্রাম, অমৃতপাল যার সাম্প্রতিক প্রতীকী প্রকাশমাত্র। ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ সংগঠনের জন্মও ওই কৃষক আন্দোলনের সময়ই। এ সংগঠন ও অমৃতপালের উত্থান এবং তাঁর বিরুদ্ধে চলমান অভিযান পাঞ্জাবের রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে এখন সবাই।
এদিকে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’র আইনজীবী ইমান সিং বলছেন, অমৃতপালকে সরকার ইতিমধ্যে আটক করেছে। এখন পলাতক দেখিয়ে হয়তো ‘এনকাউন্টারে তাঁর অন্য ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে।’ তাঁর এ রকম দাবি এই ইস্যুতে বাড়তি উত্তেজনা ছড়িয়েছে। অমৃতপালের নিরাপত্তা চেয়ে ইমান সিং ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের আলোকে পাঞ্জাব হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন। বিজেপি অবশ্য পুরো ঘটনায় পাকিস্তানের ইন্ধন রয়েছে বলে জনগণকে বোঝাচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক