আইয়ুব খানের আমলে একজন বিচারককে সন্দ্বীপে বদলি করা হয়েছিল। তাঁর ‘অপরাধ’, তিনি সরকারের বিরুদ্ধে একটি আদেশ দিয়েছিলেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন ড. কামাল হোসেন।
গণপরিষদে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছিলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারকেরা যাতে ‘ভয়ভীতি ও লোভের ঊর্ধ্বে’ থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এটি নিশ্চিত করতে হবে।
সেই মোতাবেক ১৯৭২ সালের সংবিধানে বলা হয়, জেলা জজদের নিয়োগ দেওয়া হবে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশক্রমে এবং নিম্ন আদালতের সব বিচারকের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরির ক্ষমতা শুধু উচ্চ আদালতের হাতে থাকবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য প্রণীত এসব বিধান সংবিধানে অবিকৃত থাকেনি। চতুর্থ সংশোধনী জারি করে তিন বছরের মাথায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়।
এরপর নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ এখন মূলত সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারকদের নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন, তাঁদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির নানান বিধান হয়েছে, কিন্তু সরকারের খবরদারি রোধে সেগুলো তেমন একটা ‘ভূমিকা’ রাখেনি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিরোধী দলে থাকাকালে প্রশ্ন তুলেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল। আইন কমিশনের একটি অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, কার্যক্ষেত্রে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ হয়েই থাকে।’
বাংলাদেশে বিচার বিভাগ আসলে কতটুকু স্বাধীন? ড. ইউনূসের বিচার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদিজার জামিন নামঞ্জুর, এস আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত রাখাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এই বিতর্ক আবারও জোরালো হয়েছে এখন। সমস্যা হচ্ছে, এই বিতর্ক করতে গিয়ে আমরা সাধারণত শুধু বিচারকদের বাহ্য আচরণ (আদেশ, রায় বা বক্তব্য) বিশ্লেষণ করে থাকি। বিচারব্যবস্থা নিয়ে আমাদের নির্মোহ আলোচনা কম।
অন্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রধান অঙ্গ তিনটি। তদন্তকারী সংস্থা, প্রসিকিউশন (সরকারি আইনজীবীরা) ও বিচারক। বাংলাদেশে তদন্তের কাজটি করে সাধারণত পুলিশ। গায়েবি, হয়রানিমূলক মামলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে পুলিশের ভ্রুক্ষেপহীন একপেশে ‘ভূমিকা’ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে এ দেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পুলিশের তদন্তের ভিত্তিতে বিচারকাজ শুরু হয় বলে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা প্রথমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিকভাবে সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মামলায় পুলিশের ওপর সরকারের প্রভাব থাকে আরও বেশি। একটা সময় ছিল, এসব বিষয় লক্ষ্য করে পুলিশের মধ্যে স্বাধীন ও বিশেষায়িত তদন্তকারী সংস্থা গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতো, ইউএনডিপির অর্থায়নে পুলিশের সংস্কারের লক্ষ্যে খসড়া আইনও তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল বছর পনেরো আগে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থেকেও বর্তমান সরকার এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিচারব্যবস্থায় দ্বিতীয় অঙ্গ হচ্ছে প্রসিকিউশন বা সরকারি আইনজীবীরা। সেখানেও নিরপেক্ষতা ও পেশাদারত্ব নিশ্চিত করার জন্য দাতাদের সহযোগিতায় স্বাধীন ও স্থায়ী প্রসিকিউশন বিভাগ করার খসড়া আইন হয়েছে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মতিন খসরুর আন্তরিক উদ্যোগ সত্ত্বেও এটি সংসদে তোলেনি সরকার।
তদন্ত ও প্রসিকিউশন টিমের বিভিন্ন দুর্বলতা রোধে বিচারক নিজে কিছু ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় তা নির্ভর করে বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন কি না, তার ওপর। বাংলাদেশে এমনভাবে কাজ করার ব্যবস্থা ও উদাহরণ অপ্রতুল।
বাংলাদেশে নিম্ন আদালতের বিচারকেরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন বলে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের সুযোগ নেই। তবে সেখানে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে কারও নিয়োগ আটকে দেওয়া সম্ভব, কম হলেও এসব ঘটনা ঘটছে দেশে।
বাংলাদেশে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ শুরু হয় মূলত নিয়োগপ্রক্রিয়ার পর। এর প্রতিটি স্তরে (পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা) নিম্ন আদালতের বিচারকেরা থাকেন আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এখানে উচ্চ আদালতের সঙ্গে পরামর্শের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সিনিয়রদের ডিঙিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে (বা ঢাকা মহানগরের মতো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে) নিয়োগের ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক বিবেচনায় বদলির ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উচ্চ আদালত দ্বিমত করেছেন—এমন ঘটনা এখন আর দেখা যায় না।
নিম্ন আদালতের তুলনায় কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে সরকারের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে আরও বেশি। হাইকোর্টে বিচারক পদে (বিশেষ করে উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মধ্য থেকে) নিয়োগ হয় সম্পূর্ণভাবে সরকারের মর্জিমতো।
১৯৭২ সালে গণপরিষদ বিতর্ককালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আইনজীবীদের নিয়োগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘নিশ্চিতভাবে শেষ হয়ে যাবে’ বলে সতর্ক করেছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন সরকারের আমলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের তুলনায় আইনজীবীদের মধ্য থেকে হাইকোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে একজন প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে নিয়োগে ‘প্রলয়’ ঘটে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকদের শুধু নিয়োগ নয়, দুই বছর মেয়াদান্তে তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণ, আরও সম্মানজনক আপিল বিভাগে তাঁদের নিয়োগ, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ—এমনকি অবসর শেষে বিভিন্ন আধা বিচারিক প্রতিষ্ঠানে তাঁদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে সরকারের পছন্দের ওপর নির্ভরশীল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিভিন্ন আমলে এসব নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা, বিতর্ক, এমনকি মামলার ঘটনা ঘটেছে।
উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়েছিল (ইউএনডিপির পক্ষে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা আমি নিজেই করেছিলাম)। উচ্চ আদালত নিজেও বিভিন্ন রায়ে বিচারক নিয়োগে কিছু নির্দেশিকা দিয়েছেন। কিন্তু সে অনুযায়ী বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
মানুষের শেষ ভরসার স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। কিন্তু সেটাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানাভাবে চেষ্টা করে সরকার। যে সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, তার পক্ষে তা তত বেশি করা সম্ভব হয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা দেখি, সরকারের বিষোদ্গারের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ‘আইন তার নিজের গতিতে চলবে’, ‘বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন’—এই ধরনের আপ্তবাক্য উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু বিচার বিভাগ বা ব্যবস্থাকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করার জন্য গবেষণালব্ধ যেসব সংস্কারের প্রস্তাব বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছে, তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয় না।
এরপরও রাজনৈতিক মামলায় বিচারকেরা প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করেন কখনো কখনো। এর জন্য অতীতে তাঁরা নানা হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন।
সরকারের অপছন্দের রায় প্রদানের জন্য উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল হয়েছে, একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, হাইকোর্টে বিচারকদের চাকরি স্থায়ী না করে বিদায় দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতেই এসব ঘটলে, কম ক্ষমতাসম্পন্ন নিম্ন আদালতে কী ঘটে, তা সহজেই অনুমেয়। শ্রম আদালত বা বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালগুলো এর বাইরের কিছু নয়।
এসব বাস্তবতা এড়িয়ে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন, এটি সরকার পক্ষের লোকজন বলেই চলেছেন। কিন্তু সরকারের বাণীতে মানুষের আস্থা তৈরি হয় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে, এই আস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে তদন্ত, প্রসিকিউশন ও আদালত ব্যবস্থার জরুরি সংস্কারগুলো আগে সম্পাদন করা প্রয়োজন।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক