শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়কর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে দেশটির ২০২২ সালে ঋণখেলাপি হওয়া এবং গণবিক্ষোভের কারণে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পতনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
এ ঘটনাগুলো দেশটির দুর্বল শাসন ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট বিপদগুলোকে সামনে এনেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন দেশটির চলমান সংকটের জন্য ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে। প্রতিবেদনটিতে নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেকে জনবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাহসী কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়া একটি গভীর ত্রুটিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শ্রীলঙ্কার চলমান সংকটের মূল কারণ।
আইএমএফের প্রতিবেদনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জাতীয় পুলিশ কমিশন, অডিট সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি তদন্ত কমিশন (সিআইএবিওসি), অর্থ কমিশন এবং সীমানা নির্ধারণ কমিশনের মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর দশা তুলে ধরেছে। আর এই দশার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করেছে জনসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা এবং স্বচ্ছতার অভাব।
এই মৌলিক প্রশাসন–সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধান না করা পর্যন্ত দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান রুগ্ণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে বামপন্থী জাতীয় গণশক্তি জোটের নেতা প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকেকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে সংস্কার আনতেই হবে।
প্রথমত, সিআইএবিওসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রাজস্ব ব্যয় এবং সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এটি করা গেলে সরকারি খরচাপাতির অকার্যকারিতা কমবে এবং জন–আস্থা বাড়বে।
তৃতীয়ত, করের প্রণোদনার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার রাশ টেনে ধরতে হবে। এটি করা গেলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে, রাজস্ব বাড়বে এবং আর্থিক দায়বদ্ধতা উন্নত হবে।
কাঠামোগত বৈষম্য শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত আছে, যা দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকেকে দীর্ঘদিন ধরে এই বৈষম্যকে মোকাবিলা করতে হবে।
২০১২ সালে প্রকাশিত নিজের লেখা ‘দ্য প্রাইস অব ইনইকুয়ালিটি’ বইয়ে অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎস বলেছেন, বৈষম্য নিছক কোনো নৈতিক সমস্যা নয়; এটি একটি অর্থনৈতিক সমস্যা, যা প্রবৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখতে পারে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পেছনে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যই যে প্রধান কারণ, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতিজনিত আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং অস্বচ্ছ করনীতি শ্রীলঙ্কার আয়বৈষম্যকে গভীরতর করেছে।
শ্রীলঙ্কার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বৈষম্য কমানো অত্যন্ত জরুরি। স্টিগলিৎসের অন্তর্দৃষ্টি থেকে ধারণা নিয়ে নতুন প্রশাসনকে ক্রমাগত কর সংস্কার করে যেতে হবে, যাতে নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর করের বোঝা বেশি না হয়।
এ উদ্যোগ আইএমএফের কর প্রণোদনা এবং অব্যাহতি বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
বৈষম্য হ্রাসের আরেকটি উপায় হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোর মতো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা।
এর আগে রাজাপক্ষেরা অনুৎপাদনশীল প্রকল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতেন। এখন শ্রীলঙ্কাকে সেসব অকার্যকর পুঁজি বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সমাজের অবহেলিত মানুষেরা সরাসরি উপকার পাবে, এমন প্রকল্পগুলোতে অর্থ ও সম্পদ খাটাতে হবে।
শ্রমবাজারের সংস্কারও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়সংগত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কাজের শর্ত নিশ্চিত করার ওপরও দেশটির পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দুর্বলভাবে সাজানো হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে সুযোগ করে দেয়। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় এ ব্যাপারই ঘটেছে। সেখানে স্বাধীন শাসনকাঠামোর অভাবে দুর্নীতি এবং প্রশাসনের অকার্যকারিতা বেড়েছে।
এ প্রবণতাকে উল্টে দিতে হলে প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে; স্বাধীন সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে হবে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
স্টিগলিৎস বলছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনই বৈষম্য হ্রাসের চাবিকাঠি। এই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবণতার অনুপস্থিতির বিষয়ে আইএমএফের প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছে। জনসাধারণ অংশগ্রহণ করতে পারে, এমন প্ল্যাটফর্মের অনুপস্থিতির বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছে।
একটি প্রাণবন্ত সুশীল সমাজ এবং একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তামিল টাইগারদের দমন করতে শ্রীলঙ্কা সরকার বহু দশক ধরে যেসব কঠোর নিরাপত্তা আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন জিইয়ে রেখেছে, দিশানায়েকের সরকার সেসব আইন সংস্কার করে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে।
মোদ্দাকথা, শ্রীলঙ্কাকে তার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে হলে তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করা কাঠামোগত বৈষম্যগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে।
আর এম মানিবান্নান সুপ্রিম গ্লোবাল হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ