রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট তাদের জন্য লাভজনক হলেও কোচের অভাবে নতুন ট্রেন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট তাদের জন্য লাভজনক হলেও কোচের অভাবে নতুন ট্রেন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কেন নতুন ট্রেন চালু হয় না?

সড়কপথে যানজট, দুর্ঘটনাসহ নানা রকম ভোগান্তির কারণে দূরের যাত্রায় মানুষ রেলের ওপর ভরসা রাখতে চায়। অন্যান্য পথের তুলনায় রেলের ভাড়াও কম। সে কারণে রেলের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। তবে রেল সেই চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দূরপাল্লার সড়কপথের যাত্রার বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। প্রথম আলোর ৩ জানুয়ারি সংখ্যার প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত চার বছরে সড়কে সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ কারণে সড়কপথ এড়িয়ে মানুষ রেলকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করছে। কিন্তু নিরাপদ রেলের সীমাবদ্ধতা অনেক। অপ্রতুল ট্রেন-ব্যবস্থার কারণে আমরা প্রতিদিনই শুনি রেলের টিকিটের জন্য মানুষের উদ্বেগের কথা। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে রেলের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি প্রবল হচ্ছে।

মানুষ বাড়ছে, যাত্রী বাড়ছে, কিন্তু রেলের সংখ্যা বাড়ছে না। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এই রুটে আন্তনগর ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস যুক্ত হয়েছে। এরপর আর কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন যুক্ত হয়নি। বরং মহানগর প্রভাতি নামের একটি ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন চালু আছে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, মহানগর গোধূলি, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস ও তূর্ণা এক্সপ্রেস, ঢাকা মেইল, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। এসব ট্রেনে পাঁচ হাজারের বেশি আসন রয়েছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার লোক ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করেন রেলপথে। তারপরও প্রতিদিন শত শত মানুষ টিকিট না পেয়ে হতাশ হন। নানা রকম চেষ্টা-তদবির করেন। সত্যিকার অর্থে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসার জন্য যত মানুষ টিকিট চান, তার অর্ধেকও পূরণ করতে পারে না রেলওয়ে।

নতুন বগি আর নতুন ট্রেনের দাবির প্রসঙ্গ উঠলেই রেল কর্তৃপক্ষ কোচ-সংকটের কথা তুলে ধরে সব সময়। এখন এই মুহূর্তে সেই সংকট কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। সুতরাং সময়ের কাজ সময় করা ভালো। নইলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। কদিন পরে কোচগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়ে গেলে আর কিছু করা যাবে না। তখন কোচ-সংকটের সেই পুরোনো গান আবার শুনতে হবে। সব দিক বিবেচনা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একটি নতুন ট্রেন চালু করার উপযুক্ত সময় এটি।

এদিকে চট্টগ্রাম-দোহাজারি রুটটি কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এটি চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এ কারণে এই রুটে ট্রেনের আসনসংখ্যা এবং ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও পণ্য পরিবহনেও বাংলাদেশ রেলওয়ে পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছে না। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি রপ্তানির বহু পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য এই রেলপথ ব্যবহার করা সহজ ও সাশ্রয়ী। আমদানি-রপ্তানির প্রবাহ বাড়াতে রেলের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার। কিন্তু সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না নানা সংকটের কারণে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে মাত্র চারটি ট্রেন পণ্য আনা-নেওয়া করে। এটি মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট তাদের জন্য লাভজনক হলেও কোচের অভাবে নতুন ট্রেন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু নতুন ট্রেন চালুর জন্য নয়, এখন যে কটি ট্রেন চালু আছে, সেগুলোতেও কোচের সংকট রয়েছে। এই কোচ-সংকটের মধ্যে একটি নতুন সুখবর হলো, সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে নতুন কোচ আমদানি করছে। এর মধ্যে একটি চালান ইতিমধ্যে দেশে এসে গেছে। ধাপে ধাপে মোট ১৫০টি মিটারগেজ কোচ আসবে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

১৫০টি কোচের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্লিপিং বার্থ ৩০টি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কোচ ৩৮টি, শোভন চেয়ার ৪৪টি, খাবার গাড়িসহ শোভন চেয়ার কোচ ১৬টি, পাওয়ার গাড়িসহ শোভন চেয়ার কোচ ১২টি, খাবার গাড়ি একটি এবং পরিদর্শন গাড়ি একটি। কয়েক বছর আগেও পূর্বাঞ্চলের জন্য কোচ এনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু তখন নতুন ট্রেন চালু হয়নি। আর যাত্রীদের চাহিদাও পূরণ হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের গুরুত্ব ও দূরত্ব বিবেচনায় নতুন কোচগুলো দিয়ে নতুন ট্রেন চালুর দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট খুব জনপ্রিয়। এই রুটের চাহিদা আছে। ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা কারণে ঢাকার সঙ্গে দিন দিন যোগাযোগ বাড়ছে। মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে সমানতালে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও বাড়ছে। এদিকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ বাড়ছে। এদিকে সড়কপথের ঝুঁকিও বাড়ছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের মানুষের দাবি, নতুন ১৫০টি ট্রেনের বগি দিয়ে নতুন ট্রেন চালু হোক। পাশাপাশি চালু ট্রেনগুলো থেকে পুরোনো বগিগুলোও বদল করা হোক।

চট্টগ্রাম পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদের নেতারা এই দাবি উত্থাপন করে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা বন্ধ হয়ে যাওয়া মহানগর প্রভাতিও পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি রেলের টিকিট কালোবাজারি ও অন্যান্য দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও দাবি জানিয়ে আসছেন।

নতুন বগি আর নতুন ট্রেনের দাবির প্রসঙ্গ উঠলেই রেল কর্তৃপক্ষ কোচ-সংকটের কথা তুলে ধরে সব সময়। এখন এই মুহূর্তে সেই সংকট কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। সুতরাং সময়ের কাজ সময় করা ভালো। নইলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। কদিন পরে কোচগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়ে গেলে আর কিছু করা যাবে না। তখন কোচ-সংকটের সেই পুরোনো গান আবার শুনতে হবে। সব দিক বিবেচনা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একটি নতুন ট্রেন চালু করার উপযুক্ত সময় এটি। সরকারের সংশ্লিষ্ট জনেরা আশা করি এই গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।