উখিয়ার কুতুপালং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির
উখিয়ার কুতুপালং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির

মতামত

রোহিঙ্গারা যেন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নেয়

নিজভূমি থেকে উৎখাত হয়ে মিয়ানমার তথা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমন দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।

১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং স্থানীয়দের নিপীড়নের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সীমান্তসংলগ্ন রাজ্য আরাকান (পরিবর্তিত নাম রাখাইন) থেকে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়। তখন বার্মা তথা মিয়ানমারের সামরিক শাসক ছিলেন জেনারেল নে উইন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। 

তবে ওই সময় রোহিঙ্গারা বেশি দিন বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারেনি। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারপ্রধানের সঙ্গে নে উইনের সরাসরি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। দেড় বছরের মাথায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। 

এরপরও বিভিন্ন সময়ে সামরিক জান্তার নিপীড়নের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তবে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর আবার নিপীড়ন শুরু হয়। ওই সময় প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা ভিটামাটি ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছিল। দুই বছর চেষ্টার পর একটি অংশকে ফেরত পাঠানো গিয়েছিল। বাকিরা বাংলাদেশেই রয়ে যায়।

তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় আকারের আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকার আশ্রয়শিবিরগুলোয় তারা এখনো অবস্থান করছে। সেই ঘটনার পর সাত বছর কেটে গেছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১২ থেকে ১৪ লাখ বলে অনুমান করা হয়। কারণ, সাত বছরে রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। কুতুপালং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির বলে চিহ্নিত। 

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের যে কায়দায় উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, আন্তর্জাতিকভাবে তা গণহত্যা হিসেবেও বিবেচিত। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করার পর থেকে তাদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া শুরু হয়।

১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারির পর প্রথম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়, তবে ভোটাধিকার সরকারিভাবে কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হওয়ার পর তারা সে সুযোগও হারিয়েছে।

মিয়ানমার তথা রাখাইনের সর্বশেষ জনগণনার মধ্যেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়নি। কাজেই রাখাইনে কত রোহিঙ্গা রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। শেষ গণনা বিবেচনায় নিয়ে অনুমান করা যায় যে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাস রাখাইন রাজ্যে। এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ বসবাস করে বাংলাদেশসংলগ্ন কালাদান নদীর উত্তরে, উত্তর রাখাইনে।

অনুমানের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইন মিলে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে ভিটামাটিহারা প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় শরণার্থী হিসেবে রয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। যার মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় দেড় লাখ এবং ভারতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা রয়েছে। এককথায় জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা শুধু রাষ্ট্রহীনই নয়, তাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। 

মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন একাধারে অদ্ভুত এবং বিশ্বের অন্যতম ন্যক্কারজনক আইন। এই আইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে তাদেরই গণ্য করা হবে, যারা বা যাদের পূর্বপুরুষেরা ১৮২৩ সালের আগে মিয়ানমার তথা বার্মার বাসিন্দা ছিল বলে প্রমাণিত হবে। এ ছাড়া রয়েছে অর্জিত নাগরিকত্ব।

প্রশ্ন হচ্ছে, ১৮২৩ সালকে কেন প্রাথমিক হিসেবে ধরা হয়েছে? এর কারণ ১৮২৪ সালে ভারতের ব্রিটিশ শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন বার্মার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে, যা ইতিহাসে অ্যাংলো-বার্মিজ প্রথম যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত। ওই যুদ্ধে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈনিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তারা তৎকালীন বার্মা শাসকদের কাছ থেকে আসাম, মণিপুর, কাছার, জয়ন্তিয়া এবং তৎকালীন আরাকান প্রদেশ দখল করেছিল। পরে অবশ্য আরও দুটি যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো বার্মা দখল করে ১৮৮৭ সালের মধ্যে বার্মাকে ব্রিটিশ ভারতের শাসনাধীনে আনা হয়। 

রাখাইন তথা আরাকানের অন্যতম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ইতিহাস হাজার বছরের হলেও বার্মার শাসকদের প্ররোচনায় সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। অপর দিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অপব্যবহারের শিকার হয়েছে।

রোহিঙ্গারা প্রথম ব্যাপক নিপীড়নের মুখে পড়ে যখন ১৯৪২ সালে সাময়িকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকান জাপানিদের দখলে চলে যায়। ওই সময়ে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর ‘ভি’ ফোর্সের প্রধান শক্তি ছিল। ওই সময়ই রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর চর হিসেবে জাপানিদের সহযোগী স্থানীয় আরাকানি বৌদ্ধদের রোষানলে পড়ে। দাঙ্গার ঘটনায় রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকার এবং ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। অধিকাংশই দক্ষিণ আরাকান থেকে উত্তরে, বর্তমান বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়।

মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী শুধু আরাকানের অভ্যন্তরের রোহিঙ্গাদেরই নয়, বাংলাদেশের শিবিরগুলোয় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা যুবকদেরও নাগরিকত্বের লোভ দেখাচ্ছে। ক্যাম্পের কথিত দু–একজন নেতার বক্তব্যে এমন আভাস পাওয়া যায়। রোহিঙ্গারা যদি জান্তা বাহিনীর এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়, তা হবে আত্মঘাতী। ১৯৪২-৪৫–এর ইতিহাসের কথা এসব নেতার মনে রাখা উচিত।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পরও তাদের ঐতিহাসিক ভুলের কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর তাই আরাকানি বৌদ্ধদের বিদ্বেষ কাটেনি। ২০১২-১৭ মেয়াদকালে রোহিঙ্গা নিধনের সঙ্গে আরাকানের স্থানীয় বাসিন্দাদেরও যুক্ততা ছিল। এখন সে অবস্থায় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ভবিষ্যৎ সরকার এবং সংবিধানে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এনইউজি সরকার নেতৃত্বে এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) জান্তাবিরোধী অন্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারে বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের বৃহত্তর অংশ এখন জান্তাবিরোধীদের দখলে। এনইউজি ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র করার পক্ষে এবং সেখানে জান্তাবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিতে আগ্রহী। 

এমন একটি বাস্তবতায় রাখাইনে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির আক্রমণে জান্তা বাহিনী দুর্বল ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আইন করেছে। এর বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার তরুণ দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীগুলো থেকেও পক্ষত্যাগের ঘটনা বাড়ছে।

রাখাইনের আরাকান আর্মির অবস্থান জোরদার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার অস্থায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রোহিঙ্গা যুবকদের নাগরিকত্বের প্রলোভন দেখিয়ে ও জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের স্থানীয় আরাকান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের আইন রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, আইন অনুযায়ী তারা নাগরিকই নয়। আর নাগরিকত্ব দিতে হলে শুধু আইনই নয়, সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। 

আরাকানের স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলেছে, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অনীহা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক খবর অনুযায়ী রাখাইনে কোণঠাসা জান্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যের চিয়াক তালোন অঞ্চলের একটি অভ্যন্তরীণ রোহিঙ্গা অন্তরীণ ক্যাম্পে থাকা প্রায় ১৫০ জন যুবককে ধরে নিয়ে গেছে। দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। 

রোহিঙ্গাদের এ যুদ্ধে যোগ দিতে প্ররোচনার আসল উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) বিরুদ্ধে দাঁড় করানো।

লক্ষণীয় যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে আরাকান আর্মি। রাখাইন অঞ্চলের বেশ কিছু রোহিঙ্গা আরাকান আর্মি, বিশেষ করে ইউএলএর সঙ্গে কাজ করছে বলে জানা যায়। 

মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী শুধু আরাকানের অভ্যন্তরের রোহিঙ্গাদেরই নয়, বাংলাদেশের শিবিরগুলোয় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা যুবকদেরও নাগরিকত্বের লোভ দেখাচ্ছে। ক্যাম্পের কথিত দু–একজন নেতার বক্তব্যে এমন আভাস পাওয়া যায়। রোহিঙ্গারা যদি জান্তা বাহিনীর এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়, তা হবে আত্মঘাতী। ১৯৪২-৪৫–এর ইতিহাসের কথা এসব নেতার মনে রাখা উচিত।

জান্তা সরকারের বিদায়ের পর আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের শাসনের চরিত্র বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তখন রোহিঙ্গাদের সেখানে আরাকান আর্মি এবং স্থানীয়দের সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। কাজেই সাময়িক প্রলোভনে বিভ্রান্ত হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) 

hhintlbd@yahoo.com