নতুন শিক্ষাক্রমে বড় বিপত্তি ঠেকাতে হবে

রাজনৈতিক সংকটের সময় শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কথা বলার বা শোনার পরিবেশ হয়তো নেই। কিন্তু এই আলোচনা দরকার। আরেকটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে যাচ্ছে এবং সম্ভাব্য বড় ঝুঁকি এড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভ্রান্তি ও উদ্বিগ্ন। কিছু অভিভাবক প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছেন। শিক্ষাবিদদের অনেকে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তন বা এ রকম বড় সংস্কার সফল করতে হলে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য। এক. বিদ্যালয় শিক্ষার বিশাল ও জটিল আয়োজনে একসঙ্গে অনেক রকম বড় পরিবর্তন আনা ঝুঁকিপূর্ণ। দুই. শিক্ষাক্রম সংস্কারের প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও সক্ষমতা না থাকলে বা তৈরি করতে না পারলে সংস্কার সফল হবে না।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শিক্ষককে তৈরি করা ও তাঁর সক্ষমতা ও সংস্কারের আগ্রহ সৃষ্টি করা। তিন. পরিবর্তনে অভিভাবকদের অবহিত করতে হবে এবং তাঁদের সঙ্গে রাখতে হবে। চার. কিছু ভাঙা না হলে তা মেরামতের প্রয়োজন নেই—বিদ্যালয় শিক্ষায় একসঙ্গে নানা পরিবর্তন আনার আগে এই ইংরেজি প্রবাদটি মনে রাখা দরকার।

নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের লক্ষ্য, কৌশল, প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়ন পদক্ষেপে এই বিধানগুলো মানা হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা দাঁড়িয়েছে কোভিড মহামারির কারণে শিক্ষার ক্ষতি ও আঘাত কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজন আমলে না নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনে তড়িঘড়ি এগিয়ে যাওয়া। আমাদের দেশের ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে শিক্ষাক্রমে কী লেখা থাকে, তা দিয়ে বলা যায় না শিক্ষার্থী কী শেখে, যা লেখা থাকে, শ্রেণিকক্ষে তা কাজে লাগানোর পরিবেশ, শিক্ষকের দক্ষতা ও মানসিকতা ও শিক্ষার্থীর পাঠে অংশগ্রহণের সক্ষমতা—এসবেই স্থির হয় শিক্ষার ফলাফল কী হবে।

বিদ্যমান (২০১২ সালে প্রবর্তিত) শিক্ষাক্রমে যা আছে, তা বিদ্যালয়ে কাজে লাগানো যায়নি নানা কারণে। তাই বিদ্যালয়শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও শিক্ষণ-শিখনের দিকনির্দেশনায় বড় পরিবর্তনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষাক্রম কেন কাজে লাগানো গেল না এবং সে জন্য কী শর্ত মেটাতে হতো, তা থেকে পাঠ গ্রহণ করা হয়নি। বিশেষত, শিক্ষকদের সক্ষমতা কীভাবে বাড়াতে হবে, সে বিষয়টি বিবেচিত হয়নি। সেটা করলে এত উচ্চাভিলাষী পরিবর্তন এক ধাপে করার পরিকল্পনা নেওয়া হতো না।

শিক্ষা সংস্কারে এই ধরনের আপত্কালীন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতে না হলেই ভালো হতো। কিন্তু সমূহ বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে জরুরি ব্যবস্থা প্রয়োজন। আশা করব, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দেবেন না। তাহলে ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ ও অনেক পাবলিক পরীক্ষার দৌরাত্ম্যে যা ঘটেছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের গ্রহণযোগ্য বিদ্যালয় শিক্ষার সুযোগ অন্তত এক দশকের জন্য হারিয়ে যাবে। স্মার্ট বাংলাদেশ ও চৌকস নাগরিক তৈরির স্বপ্ন তাহলে স্বপ্নই থাকবে।

এসব কথা এই লেখক ও অন্যরা বলার চেষ্টা করেছেন। (বড় সুযোগ না আসন্ন বিপর্যয়, ডেইলি স্টার, ৬ নভেম্বর ২০২৩)। ১১ নভেম্বরে রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অভিভাবকদের মোর্চায় দাবির মূল কথা ছিল—আমাদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করা হোক। বর্তমান অবস্থা চালু রাখার পক্ষে অনেকে মত দিচ্ছেন। তা ছাড়া শিক্ষাবিদদের অনেকেই তাত্ত্বিক দিক থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কৌশল সম্বন্ধে সন্দিহান। তাঁদের মতে, শিক্ষাক্রমে জ্ঞানের বিষয়গুলোকে গৌণ করে প্রায়োগিক দক্ষতায় গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থী মূল্যায়নে এই প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি একটি পাঁচতারা হোটেলে শিক্ষাক্রম নিয়ে এক জনসংযোগবিশেষজ্ঞ ঘোষণা করেন, একুশ শতকের প্রয়োজন জানা নয়, করে দেখানো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক শিখন তত্ত্বে স্বীকৃত যে জ্ঞানের ভিত্তির ওপর প্রকৃত দক্ষতা তৈরি হয়। তা না হলে মুখস্থ বিদ্যা বা যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে।

শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের উদ্বেগ ও শঙ্কায় ফেলে, ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে নতুন সংস্কারের রেলগাড়ি চালিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত বিষয়সহ শিক্ষা সংস্কারের সব উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই সবকিছু বাতিল করে স্থিতাবস্থায় ফেরার দাবি উঠছে। ইতিমধ্যে স্থির হয়েছিল বিজ্ঞান-ব্যবসা-মানবিক বিদ্যার ভিন্ন ধারায় পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নবম শ্রেণিতেই না নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে অর্থাৎ একাদশ শ্রেণিতে নেওয়া হবে। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা অল্প বয়সে এই ধরনের কঠিন বিভাজন থেকে সরে এসেছে।

অভিভাবকদের অনেকে এবং কিছু শিক্ষাবিদও এ ব্যাপারে সমালোচনা মুখর হয়েছেন। এই ধরনের এক উদ্যোগ ২০০৪ সালে অভিভাবকদের প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাখ্যাত হয়। উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের অনেকে তাঁদের সন্তানদের অল্প বয়স থেকে অর্থকরী পেশার দিকে ঠেলে দিতে চান। কিন্তু একুশ শতকের নতুন প্রজন্মের প্রয়োজন সবারই ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা আয়ত্ত করা।

নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্ম, স্বাস্থ্য, শিল্পকলা ও জীবন-জীবিকাসহ ১০টি বিষয় নবম-দশম শ্রেণির জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর সব বিষয় বাধ্যতামূলক না করে এগুলোসহ উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞান বিষয় ঐচ্ছিক রাখা যেতে পারে। এভাবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে পাঠ নিতে পারে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিদ্যালয় শিক্ষায় পরিবর্তন ও সংস্কার নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। যে কাজ হয়েছে, তা সব বাতিল করে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু বিদ্যালয় শিক্ষা বিপর্যয়ে না পড়ুক তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনটি সিদ্ধান্ত তাই এখনই নেওয়া দরকার।

এক. নতুন শিক্ষাক্রমের প্রধান লক্ষ্য ও বিষয়বিন্যাস গ্রহণ করা যায়, কিন্তু প্রস্তাবিত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং নতুন মূল্যায়নপ্রক্রিয়া ২০২৪ সালের শিক্ষাবর্ষের জন্য স্থগিত রাখতে হবে।

দুই. নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন বাস্তবায়নের ২০২৩ সালের অভিজ্ঞতার দ্রুত নির্মোহ পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের এক কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত যাচাই করে অনূর্ধ্ব তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ পেশ করবে।

তিন. দ্রুত পর্যালোচনায় ২০২৪ সালের জন্য অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ ও পরবর্তী মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপের সুপারিশ থাকবে। সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তু উপস্থাপন, শিক্ষকদের জন্য পাঠদান নির্দেশিকা ও শিক্ষক প্রস্তুতির ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষা সংস্কারে এই ধরনের আপত্কালীন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতে না হলেই ভালো হতো। কিন্তু সমূহ বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে জরুরি ব্যবস্থা প্রয়োজন। আশা করব, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দেবেন না। তাহলে ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ ও অনেক পাবলিক পরীক্ষার দৌরাত্ম্যে যা ঘটেছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের গ্রহণযোগ্য বিদ্যালয় শিক্ষার সুযোগ অন্তত এক দশকের জন্য হারিয়ে যাবে। স্মার্ট বাংলাদেশ ও চৌকস নাগরিক তৈরির স্বপ্ন তাহলে স্বপ্নই থাকবে।

  • মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। নিবন্ধে ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব