হামাস গাজায় হামলা চালানোর প্রথম প্রহরেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দেশবাসীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় মেয়রদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, এই হামলার জবাবে ইসরায়েল যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা ‘মধ্যপ্রাচ্যকেই বদলে দেবে’। তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী কয়েক দিনে আমরা শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি, তার স্মৃতি তাদের আগামী বহু প্রজন্মকে তাড়া করে ফিরবে।’
এই কথা দিয়ে নেতানিয়াহু আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? আমরা সবাই জানি, নেতানিয়াহু বহুদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে চাইছেন। ২০১০ সালে সিবিএস টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক দেরি হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা হামলা চালানোর বিষয়ে ধৈর্য ধরব না।’
আমরাও জানি, নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহ ও হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে চান। কারণ, একবার তিনি (তখন তিনি বিরোধী নেতা ছিলেন) আমাকে বলেছিলেন, এই দুটি সংগঠন হলো ইরানের ‘এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার’।
ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের হামলার পর থেকে নেতানিয়াহু এমন সব শব্দ ব্যবহার করে কথা বলছেন, যার সঙ্গে নাইন–ইলেভেন হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের দেওয়া বক্তব্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে। নাইন–ইলেভেনের পর আল–কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা করে, তখনই বোঝা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নিশানা ইরাক। আফগানিস্তান অভিযানে পাওয়া আন্তর্জাতিক সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে বুশ ইরাকে হামলা শুরু করেছিলেন।
হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে নেতানিয়াহু এখন যেভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন পাচ্ছেন, সেই সমর্থনকে কি তিনি বুশের মতোই আরও বড় কিছু পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন? ইসরায়েলের বিরোধী নেতা বেনি গানৎস আরও বড় প্রকল্পে হাত দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জিতব এবং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও কৌশলগত বাস্তবতার খোলনলচে বদলে ফেলব।’
গাজাকে দখলে নেওয়া এবং সেখানকার হামাসের মতো মাত্র একটি সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত বাস্তবতা বদলে ফেলা সম্ভব নয়। আর গাজা দখল করতে ৩ লাখ ৬০ হাজার স্থলসেনার দরকারও হয় না। অথচ এখানে আমরা দেখছি ইসরায়েল তার ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রিজার্ভ সেনা নিয়ে গাজায় ঢোকার আয়োজন করেছে।
আমার সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, হামাসের খুব বেশি হলে ৬০ হাজারের মতো সশস্ত্র সেনা আছে। এর বাইরে গাজায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব যোদ্ধা আছে, তাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে হামাস যোদ্ধাদের তিন ভাগের এক ভাগের মতো। ফলে ইসরায়েলের এই বিপুলসংখ্যক সেনা দিয়ে অভিযান চালানোর উদ্দেশ্য যে শুধু গাজা দখল নয়, তা মোটামুটি পরিষ্কার।
অসলো চুক্তি কেমন করে মধ্যপ্রাচ্যের আদল বদলে দেবে, তা ব্যাখ্যা করে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ একটি বই লিখেছিলেন। ২০০৬ সালে লেবাননে ১১ দিন ধরে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণ চালানোর সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস তেল আবিবকে যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক আহ্বানকে পাত্তা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘ভিন্ন এক মধ্যপ্রাচ্য সৃষ্টি করতে হবে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
কিন্তু ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গড়তে গিয়ে ইসরায়েল নতুন কী পরিকল্পনা নিয়েছে? সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে কী ঝুঁকি আছে?
এই প্রশ্নের প্রথম এবং অবশ্যম্ভাবী জবাব হলো, দ্বিতীয় নাকবা (আরবি ‘নাকবা’ মানে ‘মহাদুর্যোগ’। ১৯৪৮ সালে সংঘটিত ফিলিস্তিন যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনি আরবদের দেশত্যাগের ঘটনাকে নাকবা বলে। ওই সময় সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল) ঘটানো; অর্থাৎ গাজা থেকে সেখানকার ২৩ লাখ লোককে সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ করা। এটি ইসরায়েলের প্রত্যেক লোকের মাথায় আছে।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচ সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের রাফা সীমান্ত দিয়ে মিসরে পালিয়ে যাওয়া উচিত।
১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ভিটেমাটি ছেড়ে পালানো ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে মিসরকে চাপ দিয়েছিল; এবারও মিসরের ওপর সে ধরনের চাপ আসতে পারে। গাজা থেকে সিনাই উপত্যকায় ইতিমধ্যে গাজা থেকে লাখ লাখ মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। এই মানুষগুলোকে শেষ পর্যন্ত মিসরের দিকেই যেতে হবে। ফলে মিসরে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। একইভাবে জর্ডানের পূর্ব উপকূলের মানুষের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেবে।
‘দ্বিতীয় নাকবা’ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া আরব দেশগুলোতে ইসরায়েলবান্ধব সরকারের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ফিলিস্তিনিদের ‘নরপশু’ বলে উল্লেখ করেছেন। হামাস ইসরায়েলি শিশুদের গলা কেটে হত্যা করেছে বলে তিনি দাবি করলেও নিরপেক্ষ কোনো সূত্র তা নিশ্চিত করেনি। ওই একই দিন ইসরায়েলের পার্লামেন্টের সদস্য রেভিতাল গোতলিভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, এখনই গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা দরকার। জিওরা ইলান্দ নামের একজন ইসরায়েলি সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, গাজায় আরেকটি নাকবা ঘটাতে হবে। সেখানে ‘নজিরবিহীন বিপর্যয় নামাতে হবে’।
এখন বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় নাকবা শুরু হয়ে গেছে। সেখানে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা পুরো গাজা শহর থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলছেন। এর আগে নাকবার সময় গাজার ফিলিস্তিনিরা সাগরের কাছাকাছি রিমাল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এবার তা–ও সম্ভব নয়। এবার সেখানেও তীব্রভাবে বোমা বর্ষণ হচ্ছে। কোথাও কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। পালিয়ে যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই।
এর প্রতিক্রিয়ায় দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, এটি ইসরায়েলের ভেতরে ১৯৪৮ সাল থেকে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলি ইহুদিদের গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। ইসরায়েলের পথে পথে এখনই বহু ইহুদিকে আইনের তোয়াক্কা না করে অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের বেছে বেছে হত্যা করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দ্বিতীয়ত, এতে হিজবুল্লাহ তথা ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের আঞ্চলিক যুদ্ধও লেগে যেতে পারে।
এটি যে নেতানিয়াহুর মাথায় নেই, তা নয়। তিনি জানেন, শুধু হামাসকে বিধ্বস্ত করে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদল করা যাবে না। এর জন্য হিজবুল্লাহ ও ইরানকে পরাস্ত করতে হবে।
ইসরায়েলের জাতীয় পর্যায়ের ধর্মীয় দক্ষিণপন্থীরা মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের যত তাড়াতাড়ি সবংশে নিশ্চিহ্ন করা যায়, ততই ভালো। তাদের কাছে হামাসের হামলায় ইসরায়েলিদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক এখন যেন জান্নাত থেকে নেমে আসা মান্না-সালোয়া। কারণ, এই আতঙ্ককে সামনে রেখে এখন তারা ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ পাবে।
তবে এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে ক্ষোভ উগরে উঠছে, তার ঢেউ আরব দেশগুলোর প্রতিটি রাজধানীতে আছড়ে পড়বে।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই–এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক