মিসরের সীমান্ত লাগোয়া তাঁবুর শহর রাফায় গত রোববার (২৬ মে) ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র সারা বিশ্বকে শোকবিহ্বল করে তোলে।
এই গণহত্যা সে সময়ে সংঘটিত হলো, যখন গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোটা প্রায় ভেঙে পড়েছে। আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো এবং হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ‘ভগিনী মিসরের’ প্রতি দেশটির জনগণের আবেদন বাড়ছে। কিন্তু মিসরের সরকার এই আবেদনের ব্যাপারে নীরব রয়েছে।
রাফায় ওই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিসর সীমান্তে মিসরীয় ও ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে সংঘাতে দুজন মিসরীয় সেনার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মিসরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষোভের ঢেউ ওঠে।
মিসর সরকারের অবস্থান জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আরও উসকে দেয়। এই সংঘাতের খবর ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে যখন প্রচার চলছে তখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা সংবাদমাধ্যমগুলো যথারীতি সরকারি ভাষ্যের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।
মিসরের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অবশেষে একটি বিবৃতি দেয়, যেখানে উল্লেখ করা হয়, গোলাগুলির ঘটনার ব্যাপারে সেনাবাহিনী তদন্ত করছে। কিন্তু ঘটনার ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো ভাষ্য কিংবা হতাহতের কোনো তথ্য বিবৃতিতে দেওয়া হয়নি।
নিহত দুই সেনার শেষকৃত্যের সময়ও মিসর সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অবস্থান ভিন্ন ছিল না। নিহত একজন সেনাসদস্য আবদুল্লাহ রামাদানকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। কিন্তু রীতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালনকালে নিহতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মিসরের সেনাবাহিনী তাদের একজন সেনাকেও সেখানে পাঠায়নি।
অপর সেনা ইব্রাহিম ইসলাম আবদেল রাজ্জাকের নিহত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাঁর দাফনের চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেখানে সমবেত জনতাকে ইসরায়েলবিরোধী স্লোগানও দিতে শোনা গেছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরুর পর মিসরে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মিসর সরকারের অবস্থান জনগণের পুরোপুরি বিপরীতে।
মিসরের শাসকদের এই কৌশলনীতির জন্ম হয় ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অনুসারে। সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিসরে এই চুক্তিটিই একমাত্র কৌশলগত রূপকাঠামো। এই কৌশলনীতি মিসরের বর্তমান শাসকেরা অব্যাহতভাবে লাভবান হচ্ছেন, আর তাঁরা এই সুযোগকে পরিপূর্ণভাবে কাজেও লাগাচ্ছেন।
সৌদি আরবের টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিসরের তথ্যসেবা বিভাগের প্রধান তেল আবিবের সঙ্গে কায়রোর সম্পর্ককে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যকার চুক্তিটিকে একেবারে নিখুঁতভাবে মূল্যায়ন করা যায় এই ভাষ্য থেকে। চুক্তির মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় আরব রাষ্ট্র মিসরকে আরব-ইসরায়েল সংঘাত থেকে বের করে আনা গেছে। ধীরে ধীরে এটিই রাষ্ট্রটির ‘পবিত্র’ কৌশলনীতিতে পরিণত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের আমল থেকে মিসরের শাসকদের মধ্যে এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্কটি ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। এই ধারণা সিসির আমলে আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। সিসি তাঁর ক্ষমতার প্রথম দিন থেকেই এই ধারণাই লালন করে চলেছেন এবং তাতে লাভবানও হয়ে আসছেন।
যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে বছরে ১৩০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে আসছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইউরোপ ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মিত্র সংস্থাগুলো মিসরকে আরও অতিরিক্ত সহযোগিতা দিচ্ছে। সর্বশেষ আইএমএফের উদ্ধার প্যাকেজ মিসরকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে টেনে তুলেছে।
মিসরের এই কৌশলনীতি থেকে ইসরায়েলও বড় ধরনের লাভবান হচ্ছে। তারা কেবল প্রধান একটি আরব দেশকে সংঘাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না, ইসরায়েলি জনগণের কাছে এই ধারণাও প্রচার করতে পারছে যে মিসর তাদের অনুগত একটা দেশ। তারই দৃষ্টান্ত দেখা গেল, সীমান্তে মিসরীয় সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় এবং ফিলাডেলফিয়া করিডরের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলি বাহিনী নেওয়ার পরও সিসি সরকারের নীরব অবস্থান।
ফিলাডেলফিয়া করিডরের ব্যাপারে ইসরায়েলকে মিসর সতর্ক ও হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন ইসরায়েল বলছে যে মিসরের হুমকি-ধমকি ছিল শূন্য কলসের মতো আওয়াজ।
এই সমীকরণ নিশ্চিতভাবেই আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় আসা ও থাকার ক্ষেত্রে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মিসরজুড়ে নানা নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী প্রার্থী আহমেদ তানতায়ির সমর্থকদের গ্রেপ্তার, ভোটদানে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনা ঘটিয়েও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। রাফা সীমান্তে যেদিন সংঘাত হলো, সেদিন তানতায়িকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এ ঘটনাতেও নিশ্চুপ থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের সঙ্গে এই সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি মিসর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় হাজির হয়েছে। মিসর চায় যেকোনো উপায়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংঘাত যেন বন্ধ হয়। তাদের ভয় হচ্ছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে, বিশেষ করে সিনাই উপত্যকায় যদি ফিলিস্তিনিদের ঠাঁই দিতে হয়, তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের শান্তিচুক্তি ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।
সীমান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের সামরিক উত্তেজনা বাড়ছে। আর এই উত্তেজনাকে সিসি তার প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, যে তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষক। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিসি সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পথ অনুসরণ করছেন। হোসনি মোবারক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বলতে চাইতেন যে তাঁর সরকারের পতন মানে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসা।
এখন সিসি বলতে চাইছেন, তাঁর সরকার ক্ষমতা থেকে যাওয়া মানে গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসা। আর সেই শক্তি ইসরায়েলের প্রতি বৈরী হবে। কিন্তু ইসরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার পরও সিসির হাতেই যে সব সমীকরণ থাকবে, সেটা বলা যাবে না।
আহমেদ আবদিন, মিসরীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মনোজ দে