‘দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আন্তসীমান্ত নদীতে বাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারত পানি-বণ্টন নিয়ে আলোচনাটি আবারও সামনে এসেছে।’
‘দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আন্তসীমান্ত নদীতে বাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারত পানি-বণ্টন নিয়ে আলোচনাটি আবারও সামনে এসেছে।’

আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাধা কোথায় 

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনায় আন্তর্জাতিক পানি আইন বা কনভেনশনের বিষয়টি ঘুরেফিরে আসে। অথচ বাংলাদেশ এমন কোনো কনভেনশনে স্বাক্ষরই করেনি। কী আছে জাতিসংঘের এ-সংক্রান্ত কনভেনশনে? বাংলাদেশের কেন এতে স্বাক্ষর করা উচিত? এসব নিয়ে লিখেছেন পানি ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ মো. সিরাজুল ইসলামএম মনিরুল কাদের মির্জা

দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আন্তসীমান্ত নদীতে বাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারত পানি-বণ্টন নিয়ে আলোচনাটি আবারও সামনে এসেছে। দাবি উঠেছে, দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টনের বিষয়টি অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হতে হবে এবং পানির ওপর ভাটির দেশের অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। অথচ বাংলাদেশ এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইনে স্বাক্ষরই করেনি। 

বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন সমস্যার প্রেক্ষাপট

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন বড় নদী আছে প্রায় ৫৪টি। এই অভিন্ন নদীগুলোর প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে উজানে বাঁধ দিয়ে রেখেছে ভারত। শুধু গঙ্গা নদীর উজানেই এ পর্যন্ত প্রায় ৩৬টি ব্যারাজ ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টনসংক্রান্ত মতবিরোধ তুঙ্গে উঠে যখন ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হয়।

১৯৬১ সালে শুরু হয়ে এই ব্যারাজ নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯৭৪ সালে। মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা নদী থেকে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে হুগলি-ভাগীরথী নদী ব্যবস্থায় প্রবাহিত করে শুষ্ক মৌসুমে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা।

গঙ্গা নদীতে এই ব্যারাজ এবং সেটিকে ঘিরে পানি কূটনীতির এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত তাঁর লিখায় সময়ানুক্রমিক ভাগ করেছিলেন কয়েকটি ভাগে, যা অনেকটা এ রকম:

(১৯৫১-১৯৭০): ফারাক্কা বাঁধটি ঘিরে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পদ্মায় একটি বিপরীত ব্যারাজ নির্মাণের ঘোষণা।

(১৯৭২-১৯৭৬): ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল একটি অস্থায়ী ৪১ দিনের চুক্তির অধীনে ব্যারাজটি চালু করা হয়। তবে এরপর আর কখনো এটি বন্ধ হয়নি। ভারত কর্তৃক ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে একতরফা পানির প্রত্যাহার শুরু হলে সম্ভাব্য পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘে আপত্তি উত্থাপন করে।

(১৯৭৭-১৯৮২): বাংলাদেশ ও ভারত প্রথম পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর, যার মেয়াদ ছিল ১৯৭৭-৮২। চুক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’। চুক্তিটি পুনর্নবায়নের অঙ্গীকার থাকলেও তা করা হয়নি। চুক্তিটিতে ফারাক্কার উজানে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করার কথাও বলা ছিল।

তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল, যাতে সেখানকার পাহাড়ি অঞ্চলে জলাধার নির্মাণ করে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। তবে ফারাক্কার উজানে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু বিকল্প প্রস্তাবও ভারত দিয়েছিল। যার একটি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি খাল খনন করে পানি ফারাক্কার উজানে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া।

■ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন লবণাক্ততার সমস্যায় আক্রান্ত।

■ সমতার ভিত্তিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তির উদাহরণ এই উপমহাদেশেই আছে।

■ এখানে দুই পক্ষের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ এসে মধ্যস্থতাও করতে পারে, যেমনটি বিশ্বব্যাংক করেছিল সিন্ধু নদীর চুক্তির ক্ষেত্রে।

(১৯৮২-১৯৮৮): ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে ১৯৭৭ সালের চুক্তিটির সামান্য পরিবর্তন করে দুটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। একটি প্যাকেজ চুক্তির আওতায় এ অঞ্চলের সব নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন তথা চুক্তির ধারণা এ সময় আলোচনায় এলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

(১৯৮৮-১৯৯২): একতরফা পানি প্রত্যাহার আবার শুরু হয়। কিন্তু কোনো ফলাফল ছাড়াই আলোচনা চলতে থাকে।

(১৯৯৩-১৯৯৫): এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো সংলাপ হয়নি। তৎকালীন সরকার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়টি অন্যায্য উল্লেখ করে আপত্তি উত্থাপন করে।

(১৯৯৬-২০০১): ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে একটি ৩০ বছর (১৯৯৬-২০২৬) মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো এটিতে কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল না।

(২০০২-২০০৮): ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ চুক্তিটি সংশোধন এবং সালিসির জন্য একটি বিধান প্রস্তাব করে, যার কোনোটাই সম্ভব হয়নি।

(২০০৯): ১৯৯৬ সালের চুক্তিটি এখন ২০২৬ সালে শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।

ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে গঙ্গার পানি যেভাবে সংযোগ খাল দিয়ে প্রত্যাহার করে নেয় ভারত

সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে, গঙ্গা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা ‘জিডিএ’ বা গঙ্গা নদীর ওপর নির্ভরশীল অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণে গড়াই-মধুমতী নদী ব্যবস্থাসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব নদীতে মিঠাপানির স্বল্পতার জন্য লবণাক্ততা ঢুকে পড়ছে। মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন লবণাক্ততার সমস্যায় আক্রান্ত।

অন্যদিকে গঙ্গার তুলনায় তিস্তা অনেক ছোট নদী, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারাজ। এই ব্যারাজটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে ১৯৮০-৯০-এর দশকে নির্মিত হয়।

এই ব্যারাজ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচসুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক সহায়তা করে থাকে। কিন্তু ভারত জলপাইগুড়ির গজলডোবায় আরেকটি ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তার প্রায় সব পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশ অংশের ব্যারাজটি হুমকির মুখে পড়েছে।

বেশ কয়েকবার গঙ্গার মতো তিস্তা নিয়েও চুক্তির পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত, বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ নদীর জন্য বিবেচনায় নিয়ে খসড়া চুক্তি প্রস্তাব করা হয়। ২০১১ সালে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভারত, বাংলাদেশ ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০ শতাংশ পানি নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য বিবেচনায় নিয়ে নতুন প্রস্তাব আসে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তিতে স্বাক্ষরের বিষয়টি ঝুলে গিয়েছে।

প্রশ্ন হলো, কোনো রাষ্ট্র আপত্তি করলেই একটি অভিন্ন নদী থেকে উজানের দেশ মনের খুশিমতো পানি তুলে নিতে পারে কি না? নৈতিকভাবে একটি দেশের এই অধিকার নেই বলেই তো অধিকাংশ দেশের সম্মতিক্রমে একটি আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন প্রণয়ন করা হয়েছে। সর্বোপরি গঙ্গা চুক্তি করার সময়ই বলা হয়েছিল যে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের অন্য সব অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রেও ন্যায্যতার ভিত্তিতে এ ধরনের পানিবণ্টন চুক্তি করা হবে।

দেড় দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত তিস্তার সমাধান করেনি। সমতার ভিত্তিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তির উদাহরণ এই উপমহাদেশেই আছে। সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ১৯৬২ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি আছে। নানা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক টানাপোড়েনের মধ্যেও দুই দেশ এই চুক্তিটি যথাযথভাবে মেনে চলেছে।

আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে কী আছে 

দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন নিয়ে জাতিসংঘের  কনভেশনটি হচ্ছে, দ্য কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-ন্যাভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস, ১৯৯৭।  দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিক পানি চুক্তির ক্ষেত্রেও এই কনভেনশনটিকে ভিত্তি হিসেবে ধরার কথা বলা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারত—কেউই এই আইনটিতে স্বাক্ষর করেনি। আইনটিতে মোট ৭টি পর্বের অধীন ৩৭টি ধারা আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরূপ:

পানির ন্যায্য ও যুক্তিসংগত ব্যবহার: পর্ব ২—ধারা ৫(এ)-তে স্পষ্ট করে বলা আছে যে একটি আন্তর্জাতিক নদীর অববাহিকায় অবস্থিত সব দেশ এই নদীর পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ও যুক্তিসংগতভাবে ব্যবহার করবে। ধারা ৬(এ)-তে আবার স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে এই ন্যায্যতার ভিত্তি হবে দেশগুলোর প্রকৃতিগত অবস্থান, অর্থনৈতিক কার্যাবলি, জনসংখ্যা, অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি। নদীর নিজের প্রয়োজনীয়তা বা ‘এনভায়রনমেন্টাল ওয়াটার’ বলেও একটি অংশ থাকবে এতে। অর্থাৎ কোনোভাবেই কোনো দেশ সব পানি তুলে ফেলতে পারবে না।

ভারতের পানি প্রত্যাহারে শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীর পরিণতি

অন্যের ক্ষতি না করা: ধারা ৭(এ)-তে বলা হয়েছে, কোনো দেশ এমন কিছু করবে না, যাতে অন্য দেশের ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চাইলে আন্তর্জাতিক আদালতে ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারে।    

আঞ্চলিক সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদান: ধারা ৮ ও ৯(এ)-তে অববাহিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পানিসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন উজানে বৃষ্টি শুরু হলে ভাটিতে কখন বন্যা হবে, তা মডেল ব্যবহার করে বের করে ফেলা সম্ভব এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া যায়। যেমন নেপালে বা ভারতের অরুণাচলে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে সেই পানি আসতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে।  

আন্তর্জাতিক নদীতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা পরিকল্পনা: পর্ব ৩-এর ধারা ১১ থেকে শুরু করে ১৯—এই পুরো অংশে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ ধরনের ক্ষেত্রে স্থাপনা নির্মাণকারী দেশ আগে থেকে অববাহিকাসংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোকে জানাবে। কোনো দেশের আপত্তি থাকলে সে তা উপস্থাপন করবে। এর ওপর ভিত্তি করে স্থাপনা নির্মাণকারী দেশ প্রয়োজনে নকশা পরিবর্তন করবে বা সন্তোষজনক উত্তর দেবে। এ নিয়ে অববাহিকায় অন্তর্গত সব দেশের সঙ্গে প্রয়োজনে আলোচনা হবে ইত্যাদি।

প্রতিবেশ রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ: পর্ব ৪-এর ধারা ২০ থেকে শুরু করে ২৩—এই অংশে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে এমন কোনো কার্যাবলি করা যাবে না, যাতে প্রতিবেশ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ ধরনের একটি আঞ্চলিক চুক্তি হচ্ছে ইউরোপে রাইন নদী চুক্তি, যেখানে পানিদূষণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।    

জরুরি অবস্থা নিয়ন্ত্রণ: পর্ব ৫-এর ধারা ২৭-২৮ অংশে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, জরুরি পরিস্থিতি, যেমন যুদ্ধ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করণীয়। যেমন ভূমিকম্পের জন্য কোনো বাঁধ ভেঙে গেলে কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় বাঁধের গেট খুলে দিলে দ্রুত তথ্য প্রদান তথা সবাইকে সতর্ক করতে হবে। কোনো স্থাপনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

বৈষম্য করা যাবে না: ধারা ৩২-এ বলা আছে, অববাহিকার দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। অর্থাৎ পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে চুক্তিতে এক রকম আর বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য রকম—এমনটি চলবে না।  

বাংলাদেশ এখন কী করবে? 

এখন ভারত কনভেনশনটিকে স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশের বসে থাকা উচিত কি না? কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, এমনকি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পানিপ্রাপ্তির ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই প্রশ্ন আসবে কিসের ভিত্তিতে পানি চাওয়া হচ্ছে ও সংশ্লিষ্ট আইনে স্বাক্ষর করা হয়েছে কি না।

আর কোনো স্বাধীন সার্বভৌম দেশ একটি আন্তর্জাতিক আইনে স্বাক্ষর করবে কি করবে না—সেটি অন্য কোনো দেশের মর্জির ওপর নির্ভর করে না। আইনটি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কোনো আঞ্চলিক চুক্তি থাকলে তা আর কাজ করবে না এমনটি নয়। বরং এই আইনেও বলা আছে যে অববাহিকার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার জন্য এই আইনের আলোকে স্থানীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক চুক্তি করতে পারে বা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাতে পারে। তাহলে তা স্বাক্ষর করতে বাধা কোথায়?

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্কে পানির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার একটি জোর দাবি উঠলে ভারতের পক্ষ থেকেই শুধু আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল যে দ্বিপক্ষীয় বিষয় যেন সার্কে আনা না হয়। এ ধরনের নীতি আঞ্চলিক শান্তি রক্ষায় টেকসই সমাধানের পথ রুদ্ধ  করে দেয়। অববাহিকা অঞ্চলের সব কটি দেশ নিয়ে আলোচনায় বসলে হয়তো সবার জন্য একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসা যেত।

সর্বোপরি বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন বিষয়টি নিয়ে একাডেমিক আলোচনা বা গবেষণাও প্রকৃত অর্থে কম বলা চলে। শুধু পানিবিশেষজ্ঞ নন, আইনবিদ, কূটনীতিকদেরও গবেষণা করা উচিত সমাধানের পথ বা দর-কষাকষির ধরনটি কেমন হওয়া উচিত। অনেকের মতে, এখানে দুই পক্ষের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ এসে মধ্যস্থতাও করতে পারে, যেমনটি বিশ্বব্যাংক করেছিল সিন্ধু নদীর চুক্তির ক্ষেত্রে।

  • ড. মো. সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

    sirajul.islam@northsouth.edu

  • ড. এম মনিরুল কাদের মির্জা অধ্যাপক, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা