নদী রক্ষা কমিশনকে সাধুবাদ, চাই নদীর পূর্ণ তালিকা

নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা থেকে বাদ পড়া কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার তোর্সা নদী
ছবি: লেখক

গদাধর, সংকোশ, কালো, ধরণি, হারিয়াডারা, বারোমাসি, তোর্সা, গিরাই কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা নদ-নদী। আন্তসীমান্ত এসব নদ-নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকাশিত নদীর তালিকায় ছিল না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সম্প্রতি দেশের ৯০৭টি নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানেও এই নদীগুলোর নাম নেই। কুড়িগ্রাম জেলার কেবল এই নদী কয়টি নয়, সব মিলে ৩০টির বেশি নদীর নাম বাদ পড়েছে।

রংপুর জেলায় শালমারা, খটখটিয়া, শান, আলাইকুমারী, শ্যামাসুন্দরী, তিনটি বুড়াইল, ইছামতী, সোনামতী, ডোমাজানা, বাইশাডারাসহ বেশ কয়েকটি নদ-নদীর নাম জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। লালমনিরহাটের আন্তসীমান্ত নদী মালদহ, সাকোয়া, শিঙ্গিমারী ছাড়াও কালীবাড়ি, বুকশুইল্যাসহ অনেক নদ-নদীর নাম তালিকায় নেই।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা মোতাবেক দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৫। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ৮৩টি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তথ্যমতে, দেশের ৯০৭টি নদীর মধ্যে রংপুর বিভাগে নদীর সংখ্যা ১২১। এই ১২১ নদীর বাইরে আরও শতাধিক নদী আছে। সম্প্রতি রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন এবং আমি রিভারাইন পিপলের পক্ষে সেই শতাধিক নদীর নাম কমিশনের চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দিয়েছি। এর মধ্যে ৬৩টি সচিত্র, ১৬টি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ এবং ২৬টির নাম দেওয়া আছে। এগুলো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেওয়া নদীর সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। ইতিমধ্যে কমিশন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে অনেকগুলো নদীর তথ্য চেয়ে চিঠিও দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আন্তরিক বলেই মনে হয়েছে।

নদীর জন্য দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে বাংলাদেশের নদ-নদীর শতভাগ তালিকা প্রণয়ন করতে এক মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সেই তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি বাংলাদেশের ৫০ বছরেও। সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদ-নদীকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, সেই সংজ্ঞায়ন মেনেই এই তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠন করা বিভাগীয় নদী, খাল, বিল, জলাশয়বিষয়ক মহাপরিকল্পনা কমিটি কার্যকর থাকলে নদী চিহ্নিত করা আরেকটু সহজ হতো। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উচিত হবে নদীর সংখ্যা শিগগির চূড়ান্ত না করা। যখন যে নদীর নাম-তথ্য পাওয়া যাবে, তখনই সেগুলো যুক্ত করার কাজ চলমান রাখা। নদী–সম্পর্কিত অনেক মন্ত্রণালয়, দপ্তর থাকা সত্ত্বেও নদীর প্রকৃত তালিকা না পাওয়া খুবই লজ্জার।

ক্ষমতা সীমিত থাকায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এই কমিশনের জন্য ২০১৩ সালে প্রণীত আইনে ১৩টি বিষয়ে কেবল সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর আইন সংশোধন করার নির্দেশনাসহ উচ্চ আদালত এ কমিশনকে নদ-নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রথম দায়িত্ব নদীগুলোকে চিহ্নিত করা। সব নদী চিহ্নিত করা না গেলে নদীর সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে নয়।

গত ২৬ আগস্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, দীর্ঘতম নদী ইছামতী, ৩১৭ কিলোমিটার। এক কিলোমিটারের চেয়ে ছোট নদী আছে বেশ কয়েকটি। প্রস্থে অনেক সরু নদীও আছে। কমিশন এই সংখ্যাকে যেহেতু খসড়া বলছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, চূড়ান্ত তালিকায় আরও অনেক নদী যুক্ত হবে।

বাংলাদেশের নদীবিষয়ক যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার অধিকাংশের তথ্য প্রায় একই রকম। এর প্রধানতম কারণ—ওই লেখকেরা সরেজমিন অনুসন্ধান করে বই লেখেননি। সবাই কেবল নির্দিষ্ট একই তথ্যের আলোকে বই লিখেছেন। তবে বেশ কয়টি বই আছে, যেগুলো সংখ্যা বোঝার জন্য, নদীর নাম জানার জন্য, নদী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রকৌশলী ম ইনামুল হকের বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি বই আছে। এই বইয়ে সহায়তা নেওয়া যেত। কমিশন এসব নদীর নাম সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তাদের দিয়ে তথ্যগুলো যাচাই করে নিতে পারত।

ম ইনামুল হক তাঁর বইয়ে ১ হাজার ১৯২টি নদীর কথা উল্লেখ করেছেন। এর বাইরেও অনেক নদী আছে। আমি সরেজমিন অনুসন্ধান করে ১৫০টি নদীর সচিত্র পরিচিতিমূলক রংপুর অঞ্চলের নদ-নদী শীর্ষক একটি বই লিখেছি। এই বইয়ের সূত্র ধরে প্রবাহিত নদীর সংশ্লিষ্ট উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে দিয়ে যাচাই করে নিলে নদীর তথ্য আরও সমৃদ্ধ হবে। এই সচিত্র ১৫০টির বাইরে আরও কয়েকটি নদীর নাম এই বইয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে।

প্রথম আলোর খবর সূত্রে জানলাম, পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তিনি উত্তরাঞ্চলের ছোট নদীর চেয়ে দক্ষিণের অনেক খালকে বড় বলে উল্লেখ করেছেন। আপাতদৃষ্টে নদী আর খালের মধ্যে উৎস ও বৈশিষ্ট্যগত তেমন পার্থক্য আমার চোখে পড়ে না। উৎপত্তি, পতিত হওয়া ও বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য ছাড়াই নদী ও খালকে কীভাবে আলাদা করা হবে, তারও ব্যাখ্যা জরুরি।

আমাদের দেশে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নদী মাত্র ৫৭টি। এর মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৫৩টি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে মাত্র ১টি। তিনটি নদী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। স্বীকৃত ভারত-বাংলাদেশ আন্তসীমান্ত নদী রংপুর বিভাগে মাত্র ১৮টি। সরেজমিন অনুসন্ধানে জেনেছি, এই সংখ্যা চল্লিশের বেশি। নদীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যাও বাড়বে, এটায় কোনো ভুল নেই। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অবশ্যই এ সংখ্যাও চিহ্নিত করতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা খুবই কম। সামান্য এই সামর্থ্য নিয়ে যে এ কাজ করছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, এর জন্য সাধুবাদ তাদের প্রাপ্য। স্বল্প জনবলকাঠামোয় আসলে এ কাজ করা কঠিন।

বাংলাদেশে যাঁরা নদী নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে সভা করে এই তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। আমি অনেককে চিনি, যাঁরা নদী নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও এসব জানে। কিন্তু কমিশন কোনো সময়ে তাঁদের ডেকেছে কি না জানি না। নদীবিষয়ক সংগঠকদের সঙ্গে নদীর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করলে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাবে বলেই মনে করি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠন করা বিভাগীয় নদী, খাল, বিল, জলাশয়বিষয়ক মহাপরিকল্পনা কমিটি কার্যকর থাকলে নদী চিহ্নিত করা আরেকটু সহজ হতো। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উচিত হবে নদীর সংখ্যা শিগগির চূড়ান্ত না করা। যখন যে নদীর নাম-তথ্য পাওয়া যাবে, তখনই সেগুলো যুক্ত করার কাজ চলমান রাখা। নদী–সম্পর্কিত অনেক মন্ত্রণালয়, দপ্তর থাকা সত্ত্বেও নদীর প্রকৃত তালিকা না পাওয়া খুবই লজ্জার। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সেই লজ্জা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নদীর তালিকা শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক