লম্বা পাগড়ি পরে গাধার পিঠে ঘুরে বেড়ানো মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কথা অনেকেই জানেন। একবার নাসিরুদ্দিন প্রতিবেশীর কাছ থেকে বড় একটা কড়াই ধার নিয়ে গেলেন। ফেরত দেওয়ার সময় বড় কড়াইয়ের সঙ্গে ছোট একটি কড়াইও ফেরত দিলেন।
প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছোট কড়াইটা কোথা থেকে এল?’ নাসিরুদ্দিন জানিয়ে দিলেন, ‘বড় কড়াইটা তাঁর বাড়িতে থাকার সময় ছোট কড়াইটাকে বাচ্চা হিসেবে প্রসব করেছে।’ নিজের লাভ বুঝতে পেরে, অবিশ্বাস্য জেনেও, প্রশ্ন না বাড়িয়ে প্রতিবেশী কড়াই দুটি রেখে দিলেন।
কিছুদিন পর মোল্লা নাসিরুদ্দিন আবারও বড় কড়াইটি ধার চাইতে গেলেন। দুটি কড়াই ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিবেশী এবার দ্বিগুণ আগ্রহে নাসিরুদ্দিনকে কড়াই ধার দিলেন।
বেশ কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো ধরনের সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশী গিয়ে উপস্থিত হলেন নাসিরুদ্দিনের বাসায়। কড়াইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই নাসিরুদ্দিন দুঃখ করে জানালেন, ‘বড় কড়াইটা অসুখ হয়ে মারা গেছে।’
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার সঙ্গে মশকরা? কড়াইয়ের আবার অসুখ হয় কী করে?’ নাসিরুদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘যে কড়াই বাচ্চা প্রসব করতে পারে, সে কড়াইয়ের অসুখও হতে পারে।’
তবে এই ডিজিটাল যুগে এসে, একবার ধার নেওয়ার পরপরই কড়াইয়ের অসুখ হয়ে যায় না। একটি কড়াই নেওয়ার পর প্রতিবেশীকে দুটি কড়াই ফেরত দেওয়া হয়। পরেরবার দুটি ধার নিয়ে চারটি ফেরত দেওয়া হয়। এরপর চারটি নিয়ে ষোলোটা।
এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন। এরপর সব প্রতিবেশীর কাছ থেকে একসঙ্গে ধার নেওয়ার পর, কোনো এক সন্ধ্যায় জানতে পারা যায়, সব কটি কড়াই একযোগে অসুখ হয়ে মারা গেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে ‘কড়াই ধার’–পদ্ধতিতে একের পর এক চলছে প্রতারণা। উপলক্ষটুকু শুধু ভিন্ন, উদ্দেশ্য এক। কাউকে এসএমএস করে বলা হচ্ছে, প্রতিদিন ১ হাজার ১১৫ টাকা বেতন পাবেন; কাউকে বলা হচ্ছে, পোস্ট লাইক বা কমেন্ট করে একেকটি কাজের জন্য ২ থেকে ১০ হাজার টাকা আয়ের কথা; কাউকে বলা হচ্ছে, ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে স্ক্রিনশট পাঠালে বিকাশ নম্বরে ৩০০ টাকা পাঠানোর কথা; কাউকে যুক্ত করে নেওয়া হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপে।
ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব ডিজিটাল প্রতারণার উদ্ভব ঘটবে, সেটিই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এসব প্রতারণা কমিয়ে আনা যায়? এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার কম। যত দ্রুততার সঙ্গে ডিজিটাল সেবা-পরিষেবা এসেছে, ততটা দ্রুততায় ডিজিটাল সাক্ষরতার বিস্তার ঘটেনি। কিন্তু কড়াই যে বাচ্চা প্রসব করতে পারবে না, এতটুকু জানার জন্য সাক্ষরতার প্রয়োজন হয় না।
অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত আট হাজার টাকা লাভ দিয়ে, আরও লাভের কথা বলে দিতে বলা হয় ৩৬ হাজার টাকা। সে টাকা আর ফেরত আসে না কোনো দিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জানান, অনেকে ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকাও হারিয়েছে, প্রতারক চক্র দুই বছর ধরে সম্ভাব্য লেনদেন করেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার। (দ্য ডেইলি স্টার, জানুয়ারি ১৮, ২০২৪)
গত বছর প্রলোভন দেখিয়ে এমটিএফই নামের প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কোটি কোটি টাকা হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। এক বরিশাল জেলাতেই খোয়া গেছে ১০ কোটি টাকা। নানা কথার ফাঁদে কাউকে বানানো হয়েছে সিইও, কাউকে দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ডলার বিনিয়োগে বড় পদের প্রস্তাব। কিন্তু একদিন দেখা গেল, যে অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়েছিল, সেই অ্যাপটিই আর কাজ করছে না।
এ ছাড়া সিনেমার টিকিট কেনার কথা বলে, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কথা বলে, প্লেনের টিকিট কাটার কথা বলে, চাকরি দেওয়ার কথা বলে, নানান রকমের অ্যাপ তৈরি করে, বিভিন্নভাবে চলছে প্রতারণা। সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের টানের জোয়ার তো আছেই। মাঝেমধ্যে বিদেশ থেকে প্রেমের টানে ছুটে আসার খবর যেভাবে গণমাধ্যমে আসছে, তাতে করে শিগগিরই এ জোয়ারে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণও নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রেমের টানের জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমেও চলছে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়ার আয়োজন।
ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব ডিজিটাল প্রতারণার উদ্ভব ঘটবে, সেটিই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এসব প্রতারণা কমিয়ে আনা যায়?
এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার কম। যত দ্রুততার সঙ্গে ডিজিটাল সেবা-পরিষেবা এসেছে, ততটা দ্রুততায় ডিজিটাল সাক্ষরতার বিস্তার ঘটেনি। কিন্তু কড়াই যে বাচ্চা প্রসব করতে পারবে না, এতটুকু জানার জন্য সাক্ষরতার প্রয়োজন হয় না।
যত দিন হাজার হাজার মানুষ প্রতারকদের অবিশ্বাস্য প্রস্তাবে জেনেশুনে বিনিয়োগ করে যাবে, তত দিন এ প্রতারণা ঠেকানো সম্ভব নয়। সচেতন মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে এ সহায়তাটুকু করতেই হবে।
অপরদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী যে পদ্ধতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, সেটিকে আরও কার্যকর করা ছাড়া উপায় নেই।
বিভিন্ন সময় প্রতারণার দায়ে বিদেশি নাগরিকসহ গ্রেপ্তারের খবর আমরা পাই। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায়। প্রতারিত হওয়ার আগেই চক্রগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
এমন নয় যে এই চক্রগুলো গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ গোপনে করা সম্ভব নয়। উপজেলা প্রশাসন ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের সহায়তা চাইলে সহজে এ ঘটনাগুলো নজরে চলে আসবে।
রাষ্ট্রের নাগরিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সম্মিলিত তৎপরতা ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ তিনটি পক্ষের একটি পক্ষও যত দিন অসতর্ক থাকবে, তত দিন নাসিরুদ্দিনের কড়াই বাচ্চা দিয়েই যাবে।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
bmmainul@du.ac.bd