মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘সত্য অনেক সময় কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত।’
আসলেই বাস্তবে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা আমাদের ধারণার বাইরে এবং সেসব ঘটনা আমাদের হতবাক করে দেয়।
যেমন সিনেমা আমাদের কল্পনার জগৎকে বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে। বলিউডের জনপ্রিয় সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর গল্প ঠিক তেমনই। এই ছবির গল্পে দেখা যায়, তিন বন্ধুর মধ্যে র্যাঞ্চোড়দাস ওরফে র্যাঞ্চো ছিল এমন এক ছাত্র, যাকে সবাই বোকা ভাবত; কিন্তু একসময় সে পরীক্ষায় এ+ পেতে শুরু করে এবং দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়।
তবে পরে দেখা যায়, সে আসলে র্যাঞ্চো নয়; সে আসলে অন্য একজন। তার পাওয়া নম্বর সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে সে তেমন মেধাবী ছিল না।
ভারতের বর্তমান রাজনীতি এমনই এক সত্য উন্মোচনের পথে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বোঝা যাচ্ছিল মোদির বিজেপি তাদের শক্তি ও জনসমর্থন হারিয়েছে। মানুষ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ছেড়ে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈষম্যের মতো বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে। কারণ, লোকসভার ভোটে বিজেপি তাদের শক্ত ঘাঁটি অযোধ্যাতেও হেরে গিয়েছিল। এটি থেকে স্পষ্ট হয়, মোদির জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই।
সাধারণ নির্বাচনের পর সবাই ধারণা করেছিল, অক্টোবরের হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীরের এবং নভেম্বরের মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ডের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে প্রচণ্ড চাপে পড়তে হবে।
হরিয়ানায় সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল হওয়ায় সেখানে বিজেপি ভোটের ছয় মাস আগে দুবারের মুখ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়। মোদি ও অমিত শাহ সেখানকার নির্বাচনী প্রচারে কম ভূমিকা রাখেন এবং মাত্র চারটি জনসভায় যোগ দেন।
এমনকি বিজেপি প্রার্থীদের নির্বাচনী পোস্টারে মোদি-অমিতের ছবি পর্যন্ত ছিল না। জনমত জরিপ ও এক্সিট পোলগুলো কংগ্রেসের বিজয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল সবাইকে হতবাক করে দেয়। ভোটের প্রাথমিক প্রবণতা কংগ্রেসের পক্ষে থাকলেও চমক লাগানো মোড় নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজেপি জয়লাভ করে। ভোট গণনার পর দেখা যায়, বিজেপি ৯০টির মধ্যে ৪৮টি আসনে জিতে হ্যাটট্রিক করেছে এবং ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে এটি ছিল তাদের সেরা ফল।
অথচ ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ১০টির মধ্যে ৫টি সংসদীয় আসনে পরাজিত হয়েছিল।
এই রাজ্যে বিজেপি ১৯টি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি এবং ৩৯টি আসনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছে; যেখানে কংগ্রেস যথাক্রমে ১২ ও ৩২ আসনে এই পরিমাণ ভোট পেয়েছে। এই রাজ্যে বিজেপি ৪৬ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।
এটি কেমন করে সম্ভব হলো তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারবিরোধী মনোভাবের তীব্রতা, মোদির জনপ্রিয়তায় ধস, নেতৃত্বের সংকট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরও বিজেপি যে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে, তা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য প্রায় অসম্ভব একটি অর্জন।
জম্মু ও কাশ্মীরে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।
তবে এবার মহারাষ্ট্র নির্বাচনের দিকে সবার নজর ছিল। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট ৪৮টি আসনের মধ্যে ৩০টি দখল করেছে, যেখানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ মাত্র ১৭টি আসনে জয়লাভ করে।
তবে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সবাইকে চমকে দেয়। এখানেও প্রাথমিক প্রবণতা কংগ্রেস জোটের পক্ষে ছিল; কিন্তু ভোট শেষে দেখা যায়, বিজেপি ১৩২টি আসনে জয়লাভ করেছে, যা তাদের ইতিহাসে সেরা। তারা ৮৫ শতাংশের স্ট্রাইক রেট অর্জন করে এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মহাবিকাশ জোটকে পরাস্ত করে।
মাত্র ছয় মাস আগেও লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জোট যে গতি অর্জন করেছিল, তা তারা এই নির্বাচনে ধরে রাখতে পারেনি। বিজেপির এই ফলাফল তাদের নির্বাচনী কৌশল এবং স্থানীয় সংগঠনের শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসে।
দেখা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বিরোধী দল ১০ শতাংশ আসন জিতে বিরোধী দলনেতার মর্যাদা ধরে রাখতে পারেনি। মাত্র ছয় মাসে বিজেপির এই অভূতপূর্ব সাফল্য ভারতীয় রাজনীতিতে নজিরবিহীন।
তবে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র নির্বাচনের মধ্যে অসাধারণ কিছু মিল দেখা যাচ্ছে। এই মিল কিছু গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।
এবার উভয় রাজ্যেই ভোটার উপস্থিতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছাতে দেখা গেছে। মহারাষ্ট্রে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যদি এটি ‘মোদি ঢেউ’-এর প্রত্যাবর্তনের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে কেন এই জয় বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকল? কেন এই ঢেউ ঝাড়খন্ড বা জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যে ছড়াতে পারল না? এই বৈপরীত্য বিজেপির আঞ্চলিক কৌশল এবং স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।
এই ফল ইঙ্গিত করে, মোদি-শাহ জুটির কেন্দ্রীয় প্রচারণার চেয়ে স্থানীয় সংগঠন ও জোট রাজনীতির গুরুত্ব এখন অনেক বেশি। পাশাপাশি এসব ফল ইভিএম বিতর্ক এবং ভোটার আচরণের অপ্রত্যাশিত দিকগুলো নিয়ে জনমনে সন্দেহ বাড়িয়েছে।
বিজেপি যদি নিজের জয় সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে, তাহলে কেন দলের নেতা বিনোদ তাওড়ে ভোটারদের টাকা দেওয়ার মতো কাজ করতে গিয়েছিলেন?
গণমাধ্যম কেন এই তথাকথিত মোদি ঢেউয়ের আঁচ পেতে ব্যর্থ হলো? মাত্র ছয় মাসে সাধারণ নির্বাচনের ৩২ শতাংশের সাফল্যের হার থেকে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে ৮৫ শতাংশে পৌঁছানো সত্যিই নজিরবিহীন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্য শিক্ষণীয়।
হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র নির্বাচনে যে নতুন একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, সেটি হলো ভোট গ্রহণের সময়সীমা শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ভোট পড়ার হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। মহারাষ্ট্রে যেদিন বিকেল পাঁচটায় ভোট গ্রহণ হয়েছিল ৫৫ শতাংশ; তার পরের দিন একই সময় তা ৬৮ শতাংশে পৌঁছে যায়।
এই প্রবণতা থেকে সন্দেহ দেখা দেয়। ভোট নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। কারণ, এই তথ্য ফরম ভোটারের উপস্থিতি অনুযায়ী প্রিসাইডিং অফিসাররা সরাসরি রেকর্ড করেন। যদি ভোটের হার দিনের শেষে রেকর্ড করা হয়, তাহলে পরের দিন এই তথ্যের এত বড় তারতম্য কীভাবে সম্ভব?
এটি ইঙ্গিত করে, ভোট গ্রহণের সিস্টেমের মধ্যে কিছু ফাঁক বা দুর্বলতা থাকতে পারে, যা কোনো না কোনো পক্ষের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে।
প্রযুক্তিগত ডিভাইস সাধারণত দুই ধরনের অথেনটিকেশন ব্যবহার করে। প্রথমটি হলো, সিঙ্গেল ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (এসএফএ) এবং দ্বিতীয়টি হলো মাল্টি–ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (এমএফএ)।
ভারতে ভোট গ্রহণের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিতে সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। এটি ইঙ্গিত করে, ইভিএম সিস্টেমে থাকা দুর্বলতাগুলো সঠিকভাবে সমাধান না করা হলে তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
ইভিএমে বর্তমানে এসএফএ ব্যবহৃত হয়, যা ই–মেইল আইডি ও পাসওয়ার্ডের মতো সহজ অথেনটিকেশন প্রক্রিয়া।
এটি একক নিরাপত্তা স্তর সরবরাহ করে, যাতে এমএফএর মতো অতিরিক্ত নিরাপত্তা নেই। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকিং সিস্টেমে এমএফএ ব্যবহৃত হয়। এই ব্যবস্থায় একটি ওটিপি থাকে, যার মাধ্যমে শুধু অনুমোদিত ব্যবহারকারী সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারবেন।
ইভিএম সিস্টেমে সুরক্ষার অভাবের কারণে এটি হ্যাকিং বা কারসাজির ঝুঁকিতে থাকে।
ভারতীয় ইভিএম দুটি ইউনিট নিয়ে কাজ করে। একটি হলো কন্ট্রোল ইউনিট যা প্রিসাইডিং অফিসার পরিচালনা করেন। অপরটি হলো ব্যালটিং ইউনিট যা ভোটার ব্যবহার করেন। যদিও ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) ভোটারদের তাদের ভোট যাচাই করার সুযোগ দেয়; কিন্তু কেবল পাঁচটি ভিভিপিএটি মেশিনের ফলাফল চেক করা হয়, যা স্বচ্ছতা এবং নির্ভরযোগ্যতায় প্রশ্ন তোলে।
এটি আরও উদ্বেগজনক। কারণ, এখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট।
বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোদি সরকারের অধীন অর্থসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এটি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এটি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যেন একজন অভিযুক্ত তাঁর নিজের পছন্দমতো বিচারক বেছে নিচ্ছেন।
নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত ইভিএমে এমএফএ যুক্ত করা অথবা পুরোনো কাগজের ব্যালট–পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া।
অন্যথায়, ভারতের নির্বাচনপদ্ধতি রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো নির্বাচন হবে—যেখানে ভোটের ফলাফল আগেই অনুমান করা যায়।
রবি কান্ত এশিয়া টাইমসের দিল্লিভিত্তিক কলাম লেখক এবং সংবাদদাতা।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ