মতামত

বাইডেনের ধমকিতে পুতিন কেন ভয় পান না

জো বাইডেন ও ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করি, যেখানে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রধানত আগ্রাসী শক্তিকে সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে নিবৃত্ত রাখার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করা হয়। অনেক সময় ভয়ডর দেখিয়ে এক শক্তি অপর শক্তিকে বাধা দান করে থাকে। কিন্তু এই সামরিক চাপ বা ভয়ডর দেখানোই যে বৈশ্বিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখে, তা প্রমাণ করব কেমন করে?

ইউরোপে চলমান যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। ২০২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সাবধান করে বলেছিলেন, পুতিন যদি ইউক্রেনে হামলা করেন, তাহলে রাশিয়ার ওপর আরও কঠিন অবরোধ আরোপ করা হবে, যা মস্কোর জন্য মোটেও ভালো হবে না। কিন্তু পুতিন সে ভয়ডরকে পাত্তা দেননি। এরপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপিয়ান মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা দিয়ে রাশিয়াকে অধিকতর ভয়ডর দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। পুতিন ইউক্রেনে হামলা তো করলেনই; এরপর পশ্চিমারা বাড়াবাড়ি করলে এবং ইউক্রেনকে মদদ দেওয়া চালিয়ে গেলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন বলেও পাল্টা ভয়ডর দেখালেন। সেই পাল্টা ভয় দেখানোয় পশ্চিমারাও দমল না। তারা আগের মতোই ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে বাধাগ্রস্ত করতে যে চাপ সৃষ্টি করছে কিংবা ভয়ডর দেখাচ্ছে, দিন শেষে সেই চাপ বা ভয় দেখানোটা কি সফল হচ্ছে নাকি ব্যর্থ হচ্ছে। এই প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কেননা এর জবাব দিতে হলে আগে চিন্তা করে দেখা দরকার, কেউ কাউকে বাধাগ্রস্ত করতে যদি ভয় না দেখাত, তাহলে কী ঘটতে পারত। খুব নেতিবাচক কিছু যে ঘটত, তা প্রমাণ করা কঠিন।

আমি যদি আমার বাড়ির সদর দরজায় ‘এই বাড়িতে কোনো হাতি নেই’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিই এবং সত্যিই যদি আমার বাড়িতে হাতি না থাকে, তাহলে কি তার অর্থ দাঁড়াবে যে আমি কাউকে হাতির কথা বলে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দিয়েছি? এ ক্ষেত্রে আমার বাড়িতে সত্যি সত্যি হাতি থাকার মতো আলামত দেখা যাচ্ছে কি না, তার ওপর আগত ব্যক্তির বাধাগ্রস্ত হওয়া–না হওয়া নির্ভর করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বৈশ্বিক ভারসাম্য রক্ষায় শুধু ঝুঁকি কমানোটাই সব সময় যথেষ্ট হয় না, বরং প্রায়ই ঝুঁকি হ্রাসের মাত্রাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

পুতিন সম্ভবত একটি ক্ষীণ পশ্চিমা জোটের ওপর নির্ভর করে বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যর্থ হবে। তবে তিনি এখন পর্যন্ত ন্যাটো দেশগুলোর সরবরাহ লাইনে আঘাত করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন এবং পশ্চিমারা পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি সত্ত্বেও ইউক্রেনকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তারা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা অথবা আধুনিক যুদ্ধবিমান দেওয়ার বিষয়ে এখনো অনিচ্ছুক।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, কাউকে ভয় দেখিয়ে বা হুমকি দিয়ে তার কাজকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে কি না, তা আগেভাগে নির্ভুলভাবে হিসাব করা কঠিন হতে পারে। এ ধরনের ভয় দেখানোকে কার্যকর করতে হলে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হয়। যখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়, তখন হুমকি পাল্টা হুমকি চলে। কিন্তু কেউ কাউকে আগ্রাসী কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। ফলে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে।

হুঁশিয়ারিপূর্ণ বাধাদানকে কার্যকর করতে হলে সেই হুঁশিয়ারির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকাটা জরুরি। একটি ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়ার হুমকি দেওয়াটা হুমকির বিশ্বাসযোগ্যতা বা ওজন কমিয়ে দেয়। এ কথা বিশেষভাবে সত্য হয়ে ওঠে যখন আমরা একটি দূরবর্তী দেশকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পরমাণু ক্ষমতাধর দেশকে তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অঙ্গীকার করতে দেখি।

শীতলযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাসযোগ্যভাবে যথাক্রমে পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করেছিল। পশ্চিম বার্লিনের একটি ছিটমহল রক্ষা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্ককে ঝুঁকিতে ফেলবে কি না, তা নিয়ে সে সময় অনেক বিশ্লেষক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার হুমকিতে কাজ হয়েছিল, তার একটি বড় কারণ হলো, ওই সময় সেখানে আমেরিকান সেনা মোতায়েন ছিল।

তথাকথিত বার্লিন ব্রিগেড এত ক্ষুদ্র ছিল যে তাদের পক্ষে সোভিয়েতের দখল অভিযান ঠেকানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু এটি নিশ্চিত ছিল যে ওই শহরে সোভিয়েত সরকার পারমাণবিক হামলা চালালে আমেরিকান সেনারা হতাহত হবেন। ফলে মার্কিন বাহিনীকে সেখানে ঢাল হিসেবে রাখাটা তখন কাজে লেগেছিল। (আবার একই সঙ্গে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র ও গতানুগতিক সেনা মোতায়েন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে অথবা ১৯৬৪ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপের সামনে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবন্ধক ছিল না।)

সেই ইতিহাস দুই কোরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক; কারণ সেখানে উত্তর কোরিয়া একদিকে পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির শর্তে বাধা পড়ে সে ধরনের কোনো অস্ত্র বানাতে পারছে না। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরির পক্ষে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়োওল গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় তাঁরা এই বিষয়ে একমত হন যে কোরীয় উপদ্বীপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরমাণু অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজ কেন্দ্র বসানো হবে এবং শীতল যুদ্ধের সময় ন্যাটো জোটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে জড়িত ছিল, ঠিক সেই কায়দায় পরমাণু ও কৌশলগত ইস্যুতে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গভীরতর করবে।

শীতল যুদ্ধকালে বার্লিনে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি যে ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক তৎপরতা বাড়ানো সেই ধরনের অবস্থা তৈরি করবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক আগে থেকে সাড়ে ২৮ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে। তাদের সেখানে মূলত উত্তর কোরিয়ার আঘাত ঠেকানোর ঢাল হিসেবে রাখা হয়েছে। কারণ, উত্তর কোরিয়া তাদের হত্যা না করে দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ করতে পারবে না। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ফরোয়ার্ড ঘাঁটি একই ধরনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এ কারণেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বিভিন্ন দেশে থাকা মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘন ঘন কথা বলাটা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য এত ক্ষতিকর ছিল।

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তাঁর পরমাণুবিষয়ক হুমকির অকার্যকারিতা। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া সফল পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর পর ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে এমন ‘ভয়ানক সাজা দেওয়া হবে যা বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিই পরে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং কাউকে অবাক না করে উত্তর কোরিয়া তার পরমাণু অস্ত্র ধরে রেখেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি বা ভয়ডর দেখানোর বিশ্বাসযোগ্যতা হালকা হয়ে গেছে।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, কাউকে ভয় দেখিয়ে বা হুমকি দিয়ে তার কাজকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে কি না, তা আগেভাগে নির্ভুলভাবে হিসাব করা কঠিন হতে পারে। এ ধরনের ভয় দেখানোকে কার্যকর করতে হলে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হয়। যখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়, তখন হুমকি পাল্টা হুমকি চলে। কিন্তু কেউ কাউকে আগ্রাসী কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। ফলে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে।

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জোসেফ এস নাই জুনিয়র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক