মতামত

প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সফর: উন্নয়নবৈষম্য দূর করতে সুখবর চাই

প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তাঁকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত রংপুরবাসী
প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তাঁকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত রংপুরবাসী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে বিভাগীয় মহাসমাবেশে বক্তব্য দেবেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা রংপুরবাসীর জন্য সুখবর দেবেন। সেই সুখবর কী হতে পারে, এ নিয়ে জনমনে চলছে নানান জল্পনাকল্পনা।

প্রায় এক যুগ আগে শেখ হাসিনা রংপুরের জনসভায় বলেছিলেন, রংপুরের পুত্রবধূ হিসেবে রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁর নিজের। এই এক যুগে রংপুরে কিছু কাজ হয়েছে। যেমন রংপুর বিভাগ, রংপুর সিটি করপোরেশন, রংপুর মেট্রোপলিটন সিটি হয়েছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আসছে। ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক প্রশস্তকরণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। রংপুরের বিভিন্ন জেলা থেকে কয়েকটি ট্রেন ঢাকায় যাতায়াত শুরু করেছে। আরও কিছু উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা সম্ভব। এত সব করার পরও রংপুর বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব বিভাগ এবং এখানে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। এ কারণে এবার এমন ঘোষণা প্রয়োজন, যাতে দেশের উন্নয়নবৈষম্য দূর হয়।

বাংলাদেশের অন্য কোনো বিভাগের দিকে না তাকিয়ে কেবল রংপুরের দিকে তাকালে মনে হবে উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য যেকোনো বিভাগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, উন্নয়নের তলানিতে পড়ে আছে রংপুর বিভাগ। ফলে যারা দেশের অপরাপর বিভাগের খবর রাখেন না, তাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও অন্যরা চান উন্নয়ন সুষম হোক। কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে রংপুরে আসা স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রকৌশলীর কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, কুমিল্লায় একটি উপজেলায় যে পরিমাণ উন্নয়নকাজ হয়, রংপুর বিভাগীয় সদর জেলাতেও সেই পরিমাণ কাজ হয় না। এ কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। চলতি বাজেট থেকে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। রংপুর সিটি করপোরেশনে এ বছর সরকার বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ১৭ কোটি ৭ লাখ টাকা। আয়তন বিবেচনায় বর্গকিলোমিটারপ্রতি রংপুরের চেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ ১২০ গুণ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে দেশে গড় দারিদ্র্য ছিল ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ। ওই বছর রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্য ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের দারিদ্র্য-মানচিত্রে দেখা যায়, দারিদ্র্য ৭ শতাংশ কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য প্রায় ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। দেশের প্রভূত উন্নয়নের যুগেও রংপুরের গড় দারিদ্র্য যে বাড়ছে, তা কি প্রকাশ করে না এ পরিসংখ্যান?

বাংলাদেশের অন্য কোনো বিভাগের দিকে না তাকিয়ে কেবল রংপুরের দিকে তাকালে মনে হবে উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য যেকোনো বিভাগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, উন্নয়নের তলানিতে পড়ে আছে রংপুর বিভাগ

কেন রংপুর অঞ্চলের গড় দারিদ্র্য বেড়েছে, এর ওপর বিশেষ কোনো গবেষণা নেই। সরকার দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার এতগুলো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার একটিও রংপুরে বিভাগে নেই। বছর ধরে ধরে বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুর অঞ্চল তথা রংপুর বিভাগের জন্য নামমাত্র বরাদ্দ থাকে।

রংপুরে গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির দৃশ্যমান কারণ তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর ভাঙন। প্রতিবছর হাজার হাজার বাড়িঘর, লাখ লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। কেবল তিস্তায় প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার কম নয়। সেই তুলনায় সামান্য কিছু টাকা হলে এ নদীর ভাঙন থেকে জনপদ রক্ষা করা সম্ভব হতো। দীর্ঘদিন যাবৎ ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামের একটি প্রকল্পের কথা শোনা যায়। এ প্রকল্পে কী আছে, তা সরকারি সূত্রে জানা যায় না। তবে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামে হোক কিংবা অন্য যেকোনো নামে, তিস্তা নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা করা এখন এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

জলবায়ু বিবেচনায়, নদী ও নদীনির্ভর জনপদ বিবেচনায় তিস্তার বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যার ঘোষণার জন্য পথ চেয়ে আছে তিস্তাপারের, তথা রংপুর বিভাগের প্রায় দুই কোটি মানুষ। তিস্তাপারের অসহায় মানুষ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে—তিস্তা সুরক্ষার ঘোষণা আসবে প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সফরে।

বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, রংপুরের জন্য উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। শেখ হাসিনা সরকার প্রথম মেয়াদে এসে যে কাজ শুরু করেছিল, সেগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তিস্তা সড়কসেতুর কাজ বন্ধ করা তার দৃষ্টান্ত। জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কিছু কাজ হলেও তা বৈষম্য দূরীকরণের মতো ছিল না। রংপুর শহরের জন্য সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিয়ন বাতির ব্যবস্থা করেছিলেন। রাতে গরিব মানুষের শরীরের রং বদলালেও ক্ষুধার কোনো তারতম্য হতো না। তিস্তা সড়কসেতুর কাজ শেখ হাসিনার আমলে সম্পন্ন হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হয়নি।

ব্রহ্মপুত্রের ওপরে চিলমারী কিংবা গাইবান্ধা থেকে একটি টানেল কিংবা সেতু রংপুর-ঢাকার দূরত্ব অর্ধেক সময়ে নামিয়ে আনতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে শুনে আসা ব্রডগেজ রেললাইন প্রকল্পের বাস্তবায়ন, রেলপথে নাটোর দিয়ে ঘুরে ঢাকা যাওয়ার পরিবর্তে সরাসরি রংপুর-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপন জরুরি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঘোষণার দাবি অনেক দিনের। রংপুর মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক—এ আকাঙ্ক্ষাও আছে।

অনেকের ধারণা, রংপুরের উন্নয়ন ঘোষণানির্ভর। কখনো কখনো বাস্তবায়ন হয় না; হলেও তার অবস্থা শোচনীয়। যেমন ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো হয়নি। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুই হয়নি। ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ও ঘোষণার মধ্যেই আছে। রংপুরবাসী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তবায়ন চান। চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠা করাও ঘোষণার মধ্যেই আছে। চিলমারী বন্দর চালুর ঘোষণা কয়েক বছর আগে হলেও বাস্তবায়ন নেই। প্রধানমন্ত্রী রংপুরবাসীর জন্য যে ঘোষণাই দিন না কেন, তা যেন কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। তিনি নিশ্চয়ই অনতিবিলম্বে সেসবের কার্যকর ব্যবস্থাও নেবেন।

● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক