ভারতের জনসংখ্যা কমার প্রবণতা স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা শামিকা রবি সম্প্রতি বলেছেন, ভারতের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যে জন্মহার এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে এবং জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দরকার।
বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশের (যার জনসংখ্যা ১৪৫ কোটির বেশি) জন্য এটি অবশ্যই খুশির খবর হওয়া উচিত। কারণ, দেশটির অবকাঠামো এবং সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে। তবে দেশটির অনেক নেতাই জন্মহার কমের দিকে যাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
দক্ষিণ ভারতের তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল দুই রাজ্য—তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের রাজ্যবাসীকে বেশি সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পার্লামেন্টের আসন নির্ধারণ ব্যবস্থায় এমনভাবে সংস্কার আনতে চায়, যেখানে যেসব রাজ্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, তাদের আসন কমানো হবে আর যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাদের বেশি আসন দেওয়া হবে।
এই সংস্কার স্বল্প মেয়াদে বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দিলেও, দীর্ঘ মেয়াদের কথা ধরলে তা সব সময় যৌক্তিক না–ও হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন কিছু ভারতীয় নেতা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফলতাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না? কেন তাঁরা মানুষকে আরও বেশি সন্তান নিতে উৎসাহিত করছেন?
কারণ হলো প্রথমত, ভারতের জনসংখ্যা সমগ্র দেশে সমানভাবে হ্রাস পাচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে জনবহুল ও দরিদ্র রাজ্যগুলোর জনসংখ্যা এখনো দ্রুত বাড়ছে। এটি ধনী রাজ্যগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, কারণ তাদের এই দরিদ্র রাজ্যগুলোকে ভর্তুকি দিতে হয়।
দ্বিতীয়ত, ভারতের পার্লামেন্টের আসন সংস্কারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বেশি জনসংখ্যার রাজ্যগুলো বেশি আসন পাবে। এতে কম জনসংখ্যার ধনী রাজ্যগুলো (যারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল) কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।
তৃতীয়ত, জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের বহুল প্রচারিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ (অর্থাৎ কর্মক্ষম বয়সের মানুষের বড় অংশের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, উত্তর ভারতের তিনটি বড় রাজ্য—উত্তর প্রদেশ (ইউপি), বিহার ও ঝাড়খন্ডে এখনো দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে। উত্তর প্রদেশে ব্রাজিলের চেয়েও বেশি মানুষ বসবাস করে। সেখানে জন্মহার ২.৪। বিহারে এই হার ৩.০ এবং ঝাড়খন্ডে ২.৩, যা ভারতের গড় জন্মহার ২.০-এর চেয়ে বেশি এবং স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় ২.১ হারের ওপরে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের ধনী রাজ্যগুলোতে (যেখানে বেঙ্গালুরুর মতো প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং চেন্নাইয়ের মতো গাড়ি উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে) জন্মহার মাত্র ১.৭ থেকে ১.৮। এটি ভারতের গড় এবং স্থিতিশীল জন্মহারের অনেক নিচে। এই পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসা সরকারের সমর্থনপুষ্ট পরিবার পরিকল্পনা নীতির বিরোধী।
অন্ধ্রপ্রদেশে একটি আইন ছিল, যা অনুযায়ী দুইয়ের বেশি সন্তান থাকলে স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। রাজ্যটি সেই আইন বাতিল করেছে। নাইডু আরও বলেছেন, বড় পরিবার গড়া একটি ‘দায়িত্ব’ এবং ‘সমাজের জন্য সেবা’।
স্টালিন দক্ষিণ ভারতের আসন্ন সংসদীয় সংস্কারে আসন হারানোর আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘আমরা কেন ১৬ সন্তান নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করব না?’ যদিও কথাটি তামিল ভাষার একটি প্রবাদ থেকে নেওয়া এবং সম্ভবত আক্ষরিক অর্থে তিনি ১৬ সন্তান নেওয়ার কথা বলেননি। তবে এটি সম্ভবত বিজেপি সরকারের পরিকল্পিত সংসদীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করার একটি প্রচারণা হিসেবে তিনি বলেছেন।
বিজেপি সংসদ পুনর্গঠনের জন্য একটি পদ্ধতি ‘ডিলিমিটেশন’ ব্যবহার করতে চায়, যেখানে নতুন আদমশুমারি থেকে পাওয়া জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি রাজ্যের জন্য আসন নির্ধারণ করা হবে। এই আদমশুমারি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। দক্ষিণের রাজ্যগুলো এই পরিকল্পনায় ক্ষুব্ধ। কারণ, তারা মনে করছে, এটি তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফলতার জন্য শাস্তি দেওয়ার সমতুল্য।
ভারতের আসন্ন সংসদীয় পুনর্বিন্যাস (ডিলিমিটেশন) বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে, উত্তর ভারতে মোদির দলের শক্ত ঘাঁটি হওয়ায় এই অঞ্চল প্রায় ৩০টি অতিরিক্ত আসন পাবে, যেখানে দক্ষিণ ভারত সমসংখ্যক আসন হারাবে। যদি পার্লামেন্ট দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্প্রসারিত হয়, তাহলে উত্তর ভারত ১৫০টির বেশি আসন পাবে এবং দক্ষিণ ভারত পাবে মাত্র ৩৫টি আসন।
এটি বিজেপির জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক হলেও দেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি রাজ্যগুলোকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের জীবনমান উন্নত করার উৎসাহ কমিয়ে দেবে এবং ধনী, প্রগতিশীল রাজ্যগুলোকে আরও কোণঠাসা করবে।
এ অবস্থায় সরকারের ১৯৭১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের পূর্ববর্তী নীতি বজায় রাখা উচিত। এটি উত্তর ভারতকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সময় দেবে। অথবা, যদি নতুন জনসংখ্যার ভিত্তিতেই ডিলিমিটেশন করতে হয়, তবে দক্ষিণের উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের জন্য অতিরিক্ত আসনের ব্যবস্থা করা উচিত।
অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হতে পারে—অতিরিক্ত জনসংখ্যার অঞ্চল থেকে মানুষের স্থানান্তর, যেমন বিহার থেকে তামিলনাড়ুতে কাজের জন্য অভিবাসন। এটি মজুরি নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং ধনী রাজ্যের স্থানীয়দের উচ্চ বেতনের চাকরিতে প্রবেশে সহায়তা করবে।
দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে অভিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এড়িয়ে কৌশলগতভাবে একত্র হতে হবে। একইভাবে বিজেপিকে সংক্ষিপ্ত মেয়াদি স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে ডিলিমিটেশন স্থগিত করতে হবে।
● সীতারমণ শংকর বেঙ্গালুরুভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ