পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সামরিক অভিযানের জন্য ইউক্রেন তাদের ১২টি ব্রিগেডকে প্রস্তুত করেছে।
পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সামরিক অভিযানের জন্য ইউক্রেন তাদের ১২টি ব্রিগেডকে প্রস্তুত করেছে।

ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ চালালে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোর জন্য তা হবে মৃত্যুফাঁদ

যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় বসন্তের শেষে ইউক্রেন বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ হামলার পরিকল্পনা এমন এক সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন ইউক্রেনের খেতখামার ও পথগুলো ভেজা থাকবে। সে অবস্থায় খোলা মাঠের ওপর দিয়ে সাঁজোয়া যানগুলো চালানো সম্ভব নয়; কাঁচা সড়কে সেগুলো চালানো সত্যেই কঠিন।

পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সামরিক অভিযানের জন্য ইউক্রেন তাদের ১২টি ব্রিগেডকে প্রস্তুত করেছে। এই ১২টি ব্রিগেডের ৯টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাঁজোয়া যান এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। অন্য তিনটি ব্রিগেড পুরোনো আমলের রাশিয়ান সাঁজোয়া যান ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, যেগুলার কিছু কিছু ইউক্রেন আধুনিকায়ন করেছে। ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে, এই আক্রমণ থেকে ইউক্রেন বড় অর্জন প্রত্যাশা করছে। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। ইউক্রেনের পক্ষের বড় পৃষ্ঠপোষক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালেরও এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

প্রকৃতপক্ষে, ফাঁস হওয়া নথিগুলোই ভিন্ন কথা বলছে। এগুলো বাইডেন প্রশাসনের বেপরোয়া অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে সহযোগিতা করবে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের বসন্ত শেষের এই আক্রমণপরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং এমনকি আমেরিকার এশীয় মিত্রদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে উঠবে।

একটি ব্রিগেডে সাধারণত তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার সেনা থাকেন। সর্বোচ্চ সংখ্যাটি ধরে নিয়ে হিসাব করলে ইউক্রেন ৬০ হাজার সেনা দিয়ে পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এ আক্রমণের মূল লক্ষ্য হলো সেভাস্তোপল নয়, বরং কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোর ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ চালানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা তিন কারণে ফলপ্রসু হবে না। প্রথমত, সমরাস্ত্র কারখানা এখন পুরোদমে চলছে আর যুদ্ধের জন্য নতুন অস্ত্র তৈরি করে চলেছে। যুদ্ধে লোকবলে যে ক্ষয় হয়েছে, নতুন সেনা নিয়োগ করে তা পূরণ করেছে অথবা প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রাশিয়ান সেনারা খুব কার্যকরভাবে লড়ে চলেছে। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ানরা যদি জিতে যায়, তাহলে ইউক্রেনের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে।

যাহোক, ইউক্রেন যদি পারে, তাহলে তারা একই সঙ্গে ক্রিমিয়া ও সেভাস্তোপলে আক্রমণের কিছু প্রচেষ্টা নিতে পারে। এ আক্রমণপরিকল্পনার বড় অংশটিই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ে আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের মস্তিষ্কপ্রসূত। ইউক্রেন বিষয়ে তিনি বাইডেন প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি।

ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে—এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশে ন্যুল্যান্ড কোনো রাখঢাক করেননি। ন্যুল্যান্ড একজন গোঁড়া রাশিয়ানবিরোধী ও পুতিনবিরোধী। পুতিন সরকারের পতন তিনি দেখতে চান। তাঁর দৃষ্টিতে সেটা অর্জন করতে হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয় অর্জন করতে হবে ইউক্রেনকে। এর অর্থ হলো রাশিয়ার কাছে খোয়ানো প্রতি ইঞ্চি ভূমি পুনর্দখল নিতে হবে ইউক্রেনকে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ন্যুল্যান্ডের এই ভাবনার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যুল্যান্ডের দীর্ঘ একটি ইতিহাস রয়েছে। ওবামা প্রশাসনের সময় তিনি মায়দান আন্দোলনের সেই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানিয়েছিলেন, যারা ইউক্রেনের নির্বাচিত ( রাশিয়াপন্থী) সরকারকে উৎখাত করেছিল।

সে সময় ইউক্রেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ন্যুল্যান্ডের গোপন কথোপকথন ফাঁস হয়েছিল। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পরিবর্তে বিকল্প প্রেসিডেন্ট কে হবেন। ২০১০ সালের নির্বাচনে ইয়ানুকোভিচ বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম দোনেস্ক অঞ্চলে। বর্তমানে তিনি রাশিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।

অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পথ হওয়া সত্ত্বেও ইউক্রেনের সেই অভ্যুত্থানে মদদ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর পর থেকে ইউক্রেনের রুশভাষী অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ ইউক্রেনের কোনো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেননি। ২০১৯ সালে জেলেনস্কি যে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, সে নির্বাচনেও তাঁরা ভোটদানে বিরত থাকেন।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া এবং ২০২২ সালে খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়া ফেডারেশনের অংশ করে নেয় পুতিন সরকার।

ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণপরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থন থাবার পরও সেটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ বাধার মুখে পড়বে। এর একটা বড় কারণ হলো, ন্যাটো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার তুলনায় ইউক্রেনের নয়টি ব্রিগেডে পশ্চিমা সাঁজোয়া যান ও অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা অনেকটাই কম। আবার যেগুলোও আছে সেগুলোর নানা দেশের তৈরি।

এ ধরনের বিসদৃশ সাঁজোয়া যান এবং সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ নয়। আবার কোনোটাতে ত্রুটি দেখা দিলে যুদ্ধক্ষেত্রে মেরামত করা একেবারেই অসম্ভব। ইউক্রেনীয়দের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে তারা যদি ট্যাংকসহ সাঁজোয়া যান হারায়, তাহলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই।

পোল্যান্ড ও রুমানিয়ায় কয়েকটি মেরামত স্টেশন তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।

এ আক্রমণপরিকল্পনার বড় অংশটিই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ে আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের মস্তিষ্কপ্রসূত।

পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি থেকেই মিলছে যে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের রাশিয়ান বাহিনীর হামলায় সেগুলো ধ্বংস হয়েছে অথবা গোলাবারুদ একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। এমনকি ইউক্রেনের অনুরোধে সাড়া দিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেয়, তারপরও অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া সেটা কার্যকর করা সম্ভব নয়।

এর অর্থ হচ্ছে, আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে রাশিয়ানদের আধিপত্য থাকবে। যেকোনো আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা সেই সুবিধাকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধ কাজে লাগাতে পারবে। এ ছাড়া, পর্যাপ্ত গোলাবারুদের সরবরাহ নিশ্চিত না করতে পারাটাও এই পরিকল্পনার প্রধান একটি সমস্যা।

পাল্টা আক্রমণের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের এই চিত্রে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। ইউক্রেনের চাহিদামাফিক অত্যাধুনিক সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার সামর্থ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের না হওয়া পর্যন্ত কিয়েভ অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু সম্ভবত তার জন্য আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। যাহোক, এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে রাশিয়া নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে না।

ইউক্রেন ইস্যুতে এখন বাইডেন প্রশাসন যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক মীমাংসার বিরোধী। একটা গুজব আছে যে বাইডেন প্রশাসন জেলেনস্কি সরকারকে আরও নমনীয়তা দেখাতে বলেছে, কিন্তু এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ন্যুল্যান্ড ও অন্য অনেকে রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো ধরনের চুক্তির বিরোধী। কিন্তু ভিন্ন চিন্তার লোকেরাও রয়েছেন বাইডেন প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ চালানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা তিন কারণে পশ্চিমাদের জন্য মরণফাঁদ হবে। প্রথমত, সমরাস্ত্র কারখানা এখন পুরোদমে চলছে আর যুদ্ধের জন্য নতুন অস্ত্র তৈরি করে চলেছে। যুদ্ধে লোকবলে যে ক্ষয় হয়েছে, নতুন সেনা নিয়োগ করে তা পূরণ করেছে অথবা প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রাশিয়ান সেনারা খুব কার্যকরভাবে লড়ে চলেছে। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ানরা যদি জিতে যায়, তাহলে ইউক্রেনের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ন্যাটোর ওপরও বড় চাপ তৈরি হয়েছে। ন্যাটোর অস্ত্রশস্ত্রের ভান্ডার অনেকটাই খালি হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনপন্থী ইউরোপীয় রাজনীতিকেরাই এখন যুদ্ধ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া নর্ডস্টিম পাইপলাইন ধ্বংসের ঘটনাটি জার্মান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে।

তৃতীয়ত, ফিনল্যান্ড ন্যাটোর নতুন সদস্য হওয়ায় এখন আরও বড় সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ন্যাটোকে। শুধু ইউক্রেনের সীমানা রক্ষা নয়, ফিনল্যান্ডের সীমানাও রক্ষা করতে হবে তাদের।

এসব প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য বিচক্ষণ পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সহজ নয়। কেননা, রাশিয়া অস্ত্রবিরতিতে যেতে সম্মত না–ও হতে পারে। সম্ভবত, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানাতে পারে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির সিনিয়র ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত