বুয়েট, ঢাকা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ প্রভৃতি সরকারি শিক্ষাঙ্গনে যে রকম ‘ছাত্ররাজনীতি’ আছে, নর্থসাউথ বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেভাবে নেই। অভিভাবকেরা কি চাইবেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ছাত্ররাজনীতি থাকুক, যাতে আবরার ফাহাদের মতো তাঁদের সন্তানও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অথবা আবরার ফাহাদকে যারা মেরেছে, তাঁদের সন্তানও তেমন ঘাতক হয়ে ওঠেন? সম্ভবত চাইবেন না। তাই আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনগ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল।
পরে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনর্বহালের আহ্বান আসে। সিদ্ধান্ত আদালতে গড়ায়। এর একটি কারণ, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। অস্বীকার করা যাবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় নিষিদ্ধ ব্যতীত যেকোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনে যোগ দিতে পারা তাঁদের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়বে। বলা হয়, মূলধারার রাজনীতি ক্যাম্পাসে অনুমোদিত-চর্চিত না হলে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। এসব কারণেই হয়তো আমরা দেখি, আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনর্বহাল হয়।
এর ফলে একটি দ্বিধা বা সংশয়ের জন্ম হয়। একদিকে সাংবিধানিক অধিকার, অন্যদিকে আবরার ফাহাদের খুনি তৈরি করার মতো ব্যবস্থা—এ দুইয়ের মধ্যে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে। এ অচলায়তন কি অলঙ্ঘনীয়? সাধারণ শিক্ষার্থীদের কি অধিকারহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতার চক্র থেকে মুক্তি নেই? বিশ্বের অন্য অনেক দেশে শিক্ষার্থীরা সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করেন। কিন্তু তাঁদের আবরার ফাহাদের মতো পরিণতি বরণ করতে হয় না। অন্য কোনো দেশে আমাদের মতো ছাত্ররাজনীতি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কীভাবে তা সম্ভব হয়?
শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমতো ছাত্রসংগঠনের সদস্য হতেই পারেন। কিন্তু তাঁরা অন্য শিক্ষার্থীদের তাঁদের সংগঠনের সদস্য হতে বাধ্য করতে পারেন না। সিনিয়র ছাত্রনেতাদের সেবা বা তৈলমর্দনের ‘প্রটোকল’ আর মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা ক্যাম্পাসে এলে হাজিরা দেওয়ার ‘প্রোগ্রাম’—এই অংশগ্রহণ কোন আইন বা অধিকারবলে বাধ্য করা হয়? এ তো অপরাধ। এ রকম করলে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি কেন করা হবে না?
ছাত্রসংগঠনের নেতারা হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠলে কেন শাস্তি হবে না?
সাংবিধানিক অধিকার ও অভিভাবকদের চাওয়ার মধ্যে বিরোধ নেই। সমস্যাটা হলো আইন, সংবিধান ও অধিকারের কথা বলে এক কদর্য ও অসুস্থ ছাত্ররাজনীতি চালু রাখা। এই ছাত্ররাজনীতির কুশীলবেরা যখন সিংহভাগ শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার হরণ করেন, তখন প্রশাসন, আইন আর সংবিধান শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। আবরার ফাহাদের মতো চরম পরিণতিই কেবল প্রশাসন ও আইনকে একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। কিন্তু কোনো আমূল পরিবর্তন তারা করে না।
একটু কল্পনা করার চেষ্টা করুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল প্রশাসন পরিচালিত। অর্থাৎ প্রশাসকেরা তাঁদের কাজ দয়া করে করছেন। আর ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবেই ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হতে পারেন। যুক্ত হয়ে তাঁরা সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আয়োজন করেন। কাউকে জোর করে তাঁদের দল বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধ্য করেন না। কল্পনা করুন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে। সেখানে সব সংগঠন আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করছেন। কেউ জয়ী, কেউবা পরাজিত হচ্ছেন। প্রতিবছর একইভাবে নির্বাচন হচ্ছে। ছাত্র সংসদে শিক্ষার্থীরা কী নিয়ে কথা বলবেন? হলের খাবারের মান, সার্টিফিকেট তোলার সমস্যা নিয়ে বলবেন। বলবেন সেশনজটের মতো সমস্যার কথা। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের যথাযথ মনোযোগ ও পরিষেবা পাওয়ার কথা বলবেন।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির এত বছরের ইতিহাসে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন নিয়ে তথাকথিত বড় কোনো সংগঠন আন্দোলন করেছে? এ কথাও মনে রাখতে হবে, ছাত্র সংসদ কার্যকর না করা আর পেশাজীবীদের ট্রেড ইউনিয়ন না করতে দেওয়া সমার্থক।
ক্ষমতাধরদের দৃষ্টিকোণ থেকে ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ভেবে দেখুন। তাঁরা চান বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে। তাহলে যেকোনো বিরুদ্ধ ন্যায্য আন্দোলন সহজেই দমানো যায়। হয়তো ‘গেস্টরুম’ ও ‘পলিটিক্যাল রুম’ দ্বারাই তাঁরা যা চান, তা পাবেন বলে ভাবেন।
ছাত্ররাজনীতির একটি মূল ব্যাপার হলো যাঁদের আবাসনের জন্য হলে থাকতে হয়, তাঁদের সেই চাহিদাকে পুঁজি করে তাঁদের ব্যবহার করা। কেন্দ্রীয় নেতাদের এই সহিংসতার প্রয়োজন। এ কারণেই কি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অমানবিক গণরুমে তোলা যায়, গেস্টরুমে নির্যাতন করা যায়, আবরার ফাহাদকে ‘পলিটিক্যাল রুমে’ নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়।
প্রতিটি ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতিকে তাঁদের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন। এই ক্যারিয়ারের অর্থনৈতিক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, উৎকোচ নেওয়া ও চাঁদাবাজি করা। অন্য সুবিধার মধ্যে আছে বিনা মূল্যে ক্যানটিনে খাওয়া, সবার কাছ থেকে সালাম আদায় করা, সাধারণ ছাত্রদের তুলনায় হাজার গুণ আরামে থেকে হলের সবার ‘ভাগ্যনিয়ন্ত্রক’ হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকা। এ ধরনের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি মনস্তাত্ত্বিকভাবে আকর্ষণীয়। তাই বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামো যে এই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাতে সন্দেহ নেই।
অসুস্থ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন আর তাদের মূল দল, যাদের রাস্তায় ‘আন্দোলন’ করার জনবল প্রয়োজন। ক্ষমতাধরর পদলেহনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকেরা যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের হয়ে কাজ করেন। তাঁরা স্বাভাবিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, এটা আশা করা কষ্টকর।
গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের একটি গুরুদায়িত্ব হলো সত্যিকারের অধিকার-সুরক্ষামূলক ছাত্ররাজনীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা। আর এর জন্য সঠিক ব্যক্তিদের আবাসিক হলে ও অন্যান্য প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে যেকোনো শিক্ষার্থী যেকোনো অন্যায় ও অপরাধ করলে তাঁকে প্রশাসনিক ও আইনি বিচারের সম্মুখীন করা। এই অন্যায়ের মধ্যে শুধু মানুষ পিটিয়ে হত্যা করাই নয়, বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা ও যেকোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপও ধর্তব্য।
নাভিদ মুস্তাহিদ রহমান বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি গবেষণারত।