মতামত

রানা প্লাজা ধস: ১০ বছরেও যে কারণে বিচার শেষ হয়নি

২৪ এপ্রিল ২০১৩, রানা প্লাজা ধসে পড়লে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়
ফাইল ছবি

সব বিচার কি সমান? কোনো কোনো বিচার ১০ মাসেই শেষ হয়ে যায়, আবার কোনো বিচার ১০ বছরেও শেষ হয় না। যেসব দেশে ন্যয়বিচার ও আইনের শাসনের অস্তিত্ব থাকে না, সেখানে কাগজে–কলমে আইন সবার জন্য সমান হলেও বাস্তবে আইন ক্ষমতার হাত ধরে চলে। যদি কোনো অপরাধের ভুক্তভোগী ক্ষমতাবান আর অপরাধী দুর্বল জনগোষ্ঠীর কেউ হন, তাহলে তার বিচার যত দ্রুতগতিতে হয়, ভুক্তভোগী দুর্বল বা প্রান্তিক শ্রেণির আর অপরাধী ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর কেউ হলে ততটাই দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।

বাংলাদেশে সাগর-রুনি, ত্বকী, তনু হত্যার মতো আলোচিত ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ার সঙ্গে ভুক্তভোগী আর অপরাধীর ক্ষমতাসম্পর্কের এই অসমতার যোগসূত্র রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। একইভাবে, রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার বিচার ১০ বছরেও সম্পন্ন না হওয়ার পেছনে অসম ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই শিল্পদুর্ঘটনায় করা অবহেলাজনিত হত্যা মামলাটির বিচার এমন ধীরগতিতে চলছে যে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ১৫ মে ২০২৩। আর ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার অভিযোগে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে করা মামলাও দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত হয়ে আছে হাইকোর্টে।

দেশে দিনের পর দিন নিয়মিত বিভিন্ন কারখানা ও ভবনে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে চললেও মালিকপক্ষ ও তদারককারীদের এ ধরনের কঠোর কোনো বার্তা দেওয়ার আগ্রহ সরকারের দিক থেকে দেখা যায় না। আসলে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোয় ক্ষমতাসীনদের দরিদ্র, শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বরং বিভিন্ন দেশি–বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখলেই চলে, সে কারণে এসব অবেহলাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।

এমন নয় যে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় কারা কীভাবে দায়ী, তা কেউ জানেন না। ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলার পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। উচিত ছিল কাঠামো প্রকৌশলীদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিরাপদ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারখানার সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা। কিন্তু পাঁচ পোশাক কারখানার মালিক ও তাঁদের লোকজন পরদিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও তাঁর ছেলে সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’ অবহেলা শুধু যে ২৩ এপ্রিলেই ঘটেছিল তা নয়, রানা প্লাজা তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন ভবনটির মালিক ও তাঁর ছেলে, যা রানা প্লাজা ভবনটিকে একটি মৃত্যুকূপে পরিণত করে।

এ রকম একটা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঘটনার দিন ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকালে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর যখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে, তখনই রানা প্লাজা ভবনটি বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে আর করুণ অকালমৃত্যু হয় ১ হাজার ১৩৫ শ্রমিকের, পাশাপাশি গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও ১ হাজার ১৬৯ জন। এ ঘটনায় ভবনমালিক, ভবন নির্মাণ ও তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও ভবনে স্থাপিত গার্মেন্টস কারখানার মালিকদের চরম অবহেলা রয়েছে, এটা তো খুবই স্পষ্ট। তাহলে ১০ বছরেও এই ঘটনার বিচার না হওয়ার পেছনে অসম ক্ষমতার সম্পর্ক ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে!

রানা প্লাজার ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা অসংগঠিত, ক্ষমতা থেকে বহু দূরে তাঁদের অবস্থান। অন্যদিকে অভিযুক্ত ভবনমালিক, কারখানামালিক কিংবা বিভিন্ন তদারকি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানাভাবেই ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে আইনি–বেআইনি নানা উপায়ে তাঁদের পক্ষে বিচারে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র ও সরকার এখানে যে রকম কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত, তা করেনি বলেই এই ঘটনার তদন্ত ও বিচারে অবহেলা ও দীর্ঘসূত্রতা দেখা গেছে শুরু থেকেই। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা

অবহেলাজনিত হত্যা মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হতেই সময় লেগেছে ৯ বছর। ২০১৩ সালে অবহেলাজনিত হত্যা মামলা করার পর তদন্ত করে অভিযোগপত্র তৈরি করতে সময় লাগে দুই বছর। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভবনমালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এরপর অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের কার্যক্রম শুরুর আদেশ হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে।

কিন্তু এই অভিযোগ গঠনের পরপরই আট আসামি উচ্চ আদালতে গেলে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দুনিয়া তোলপাড় করা সহস্রাধিক শ্রমিক মৃত্যুর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ পাঁচ বছর ধরে স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। নিউ এজ এবং আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এরপর গত ১ বছর ৩ মাসে মাত্র ৩৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। দুজন আসামি মারা যাওয়ায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৯। এর মধ্যে জামিনে আছেন ৩১ জন, পলাতক ৭ জন, কারাগারে আছেন কেবল রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা।

১০ বছরে যদি মামলার এই পরিস্থিতি থাকে, তাহলে ৫৯৪ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন করে বিচার পুরোপুরি শেষ হতে কত দিন লাগবে, তা অনুমান করাও মুশকিল! রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় ভবনমালিক, কারখানামালিক ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা প্রমাণের জন্য কী কারণে ৫৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রয়োজন, সেটাও আসলে স্পষ্ট নয়। ভবনের নির্মাণত্রুটিসংক্রান্ত কারিগরি প্রতিবেদন এবং ফাটল দেখা দেওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করার ঘটনার প্রত্যক্ষ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবহেলা প্রমাণ করতে পারা উচিত। এ ক্ষেত্রে ৫৫৪ জনকে সাক্ষী মানার উদ্দেশ্য কি অভিযোগ প্রমাণের জন্য, নাকি বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরির জন্য, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

শুধু রানা প্লাজা নয়, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক পোশাকশ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনারও বিচার হয়নি। অথচ মালিকপক্ষের চরম গাফিলতির কারণেই যে এতজন শ্রমিকের অকালমৃত্যু হয়েছিল, সেটা নানাভাবেই স্পষ্ট ও প্রমাণিত। কারখানা ভবনের বাইরের দিকে কোনো সিঁড়ি বা ফায়ার এসকেপ বলে কিছু ছিল না। তার ওপর আগুন লাগার পরপরই কলাপসিবল গেটগুলোর তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও মালিক-কর্তৃপক্ষের শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে সার্বিক অবহেলাকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। এ রকম একটি সুস্পষ্ট অপরাধের ঘটনার ১০ বছরের বেশি সময় পার হলেও বিচার শেষ হয়নি।

শহীদ মিনারে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রতিবাদ কর্মসূচি

রানা প্লাজার মতো তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতা ছিল শুরু থেকেই। শতাধিক শ্রমিক হত্যার মামলার অভিযোগ গঠন করতেই পার করা হয় তিন বছর। এরপর শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা। সমকালে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এই ১০ বছরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য মোট ৪৬টি তারিখ ধার্য হয়, যার মধ্যে মাত্র ৯ দিন রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে এবং অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ১০৪ জনের মধ্যে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র ৯ জনের। এই গতিতে চললে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হতে কত বছর লাগবে, তা বলা মুশকিল।

অন্যদিকে মামলার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে জামিনে আছেন। প্রথম আলোয় খবর এসেছে, ২০১৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং ২০২২ সালের মে মাসে তাঁকে সংগঠনটির সভাপতিও নির্বাচিত করা হয়েছে।

শুধু রানা প্লাজা ধস বা তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই নয়, অবহেলায় শ্রমিকের মৃত্যুর কোনো ঘটনায়ই কারখানার মালিক, পরিচালক কিংবা তদারকি সংস্থার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও বিচার ও শাস্তি হয়নি। দৈনিক কালবেলার সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ জন, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে ৫৪ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায়ও কারও শাস্তি হয়নি। এসব ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর পেছনে যেমন কাঠামোগত অবহেলা রয়েছে, বিচার না হওয়ার পেছনে তেমনি জবাবদিহিহীন ক্ষমতাকাঠামো দায়ী।

কারখানার মালিকের দায়িত্ব হলো শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা আর সরকারের দ্বায়িত্ব হলো, মালিকপক্ষ তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে কি না, সেটার তদারক করা। মালিকপক্ষ যদি নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করে এবং তদারকি সংস্থার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন, তাহলে সরকারের কাজ হলো, জরিমানা ও শাস্তির মাধ্যমে এমন একটি বার্তা দেওয়া যেন মালিকপক্ষ ও তদারককারীদের কাছে নিরাপত্তায় অবহেলা ও দুর্নীতি লাভজনক মনে না হয়।

কিন্তু দেশে দিনের পর দিন নিয়মিত বিভিন্ন কারখানা ও ভবনে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে চললেও মালিকপক্ষ ও তদারককারীদের এ ধরনের কঠোর কোনো বার্তা দেওয়ার আগ্রহ সরকারের দিক থেকে দেখা যায় না। আসলে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোয় ক্ষমতাসীনদের দরিদ্র, শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বরং বিভিন্ন দেশি–বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখলেই চলে, সে কারণে এসব অবেহলাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com