নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন এত তাড়া

খবরে দেখলাম, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কার না চায়, তাহলে তিনি নির্বাচন দিয়ে চলে যাবেন। এটা তাঁর অভিমানের কথাও হতে পারে, ক্ষোভের প্রকাশও হতে পারে।

এখানেই আমার প্রশ্ন, দেশের মালিক অধ্যাপক ইউনূস নন, রাজনৈতিক দলগুলোও নয়; দেশের মালিক জনগণ। রাজনৈতিক দলগুলোর একেকটার একেক ধরনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা থাকে। তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে কথাবার্তা বলে। দাবিদাওয়া জানায়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল আছে। বিগত নির্বাচন কমিশনে ৩৯টি দল নিবন্ধিত ছিল। ৫ আগস্টের পর আরও কয়েকটি দল নিবন্ধন পেয়েছে।

যাহোক, সব রাজনৈতিক দল এক সুরে কথা না বললেও অনেকগুলো দলের মধ্যে সুরের একটা মিল দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বড় দল বিএনপি। রাজনীতির মাঠে একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। কারণ, যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন, তাঁরা কেউ পালিয়েছেন, কেউ গর্তে লুকিয়েছেন। দলগতভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় নামবে কি না, সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও মতভিন্নতা আছে। কিছু কিছু দল, বিশেষ করে বিএনপি, রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে চাইছে। এটার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?

আমার উপলব্ধি হলো, আওয়ামী লীগের যাঁরা অনুগত সমর্থক, আওয়ামী লীগ যদি ভোটে না আসে, সেই ভোটাররা কী করবেন? তাঁরা কি ভোট দিতে যাবেন না? তাঁরা যদি ভোট দিতে না যান, তাহলে বাকি ভোটের বেশির ভাগ বিএনপির বাক্সে পড়বে বলে তারা আশা করে।

আওয়ামী লীগের যাঁরা অন্ধ সমর্থক, তাঁরা যদি ভোট দেন, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই বিএনপিকে ভোট দেবেন না। বিএনপির প্রতিপক্ষ অন্য কাউকে ভোট দিলে নির্বাচনের মাঠের সমীকরণটা বদলে যেতে পারে। এখানেই বিএনপির আশঙ্কা। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি চাইবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে থাকুক এবং নৌকার ভোট যেন অন্য কোনো দল না পায়। বিএনপি সম্ভবত এই সমীকরণ কষছে।

নির্বাচন যদি তাড়াতাড়ি হয়, তাহলে রাজনীতিতে যে শূন্যতা চলছে, তাতে বিএনপি অনেক সুবিধা পাবে। যত দেরি হবে, ততই বিএনপির মাঠ পিচ্ছিল হবে। ইতিমধ্যেই লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ যে খারাপ কাজগুলো করেছে, এখন আওয়ামী লীগ না থাকলেও সেই খারাপ কাজগুলো বন্ধ হয়নি। সেগুলো অনেকগুলো বিএনপির লোকেরা এখন করছে।

আমরা পত্রিকায় দেখছি, চাঁদাবাজি, দখল—এসব অপকর্মের জন্য বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের অনেকেই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। কিছুদিন আগে ঢাকায় খুনের অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিএনপি তাঁকে বহিষ্কারও করেছে। বাংলাদেশে খারাপ কাজগুলো করার লোকের অভাব হয় না। তারা নির্দিষ্ট একটা দলের নয়, বিভিন্ন দলের আশ্রয়ে–প্রশ্রয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ একসময় বলত, অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে এসব করে। এটা বলে তারা নিজেদের একটা দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করত। বিএনপিও সেটা করতে পারে। কিন্তু মানুষ এ কথায় বিশ্বাস করে না।

যাহোক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনি আগে যেমন চলত, এখনো তেমন চলছে। যত দিন যাবে, এসব প্রবণতা ততই বাড়বে। ফলে বিএনপির জনপ্রিয়তার পারদটা একটু একটু নামতে থাকবে। বিএনপির আশঙ্কা, যত দেরিতে নির্বাচন হবে, ততই নির্বাচনী মাঠ বিএনপির প্রতিকূলে যাবে।

বিএনপি সরাসরি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে না, কিন্তু নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইছে। রোডম্যাপ মানে হলো নির্বাচন কবে হবে, সেটা আগাম বলে দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডায় নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সরকারের মধ্যে ক্ষমতার কয়েকটি ভরকেন্দ্র আছে। এর মধ্যে একটি ভরকেন্দ্র হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। তাঁরা এই মুহূর্তে নির্বাচন চাইছেন না। তাঁরা চাইছেন সংস্কার। তাঁরা বলছেন, এতগুলো মানুষ প্রাণ দিলেন, এতগুলো মানুষ আহত হলেন, এটা কি শুধুই এক দলকে সরিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য? রাষ্ট্রব্যবস্থা আগে পাল্টাতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর কপাল ভালো যে ছাত্রদের আন্দোলন সর্বস্তরের জনতার সমর্থনে একটি পরিণতির দিকে গেছে। এখন দেশে একটা খোলা হাওয়া বইছে। সবাই যার যার কথা বলতে পারছে। একটা বিষয় তাদের বোঝা দরকার যে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে জুলাই–আগস্টের আন্দোলন হয়নি। রাজনৈতিক দলের ব্যানারে হলে সেটা কোনো দিনই সফল হতো না।

শুরুর দিকে অধ্যাপক ইউনূসও জোরেশোরে সংস্কারের কথা বলেছেন। তিনি এমনও বলেছিলেন, ‘প্রথম স্বীকার করতে হবে যে ছাত্ররা বলেছে, আমরা “রিসেট বাটন” পুশ করেছি; এভরিথিং ইজ গন; অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা গড়ে তুলব।’ যদিও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এটার অর্থ বিকৃত করে বলেছিল, এখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একাত্তর নিয়ে প্রচুর ব্যবসাপাতি করেছে। এখন সেই ব্যবসায় ভাটা। সে কারণে তারা অধ্যাপক ইউনূসের মন্তব্য ধরে জনগণের মাঝে সুড়সুড়ি দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমার কাছে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা হচ্ছে, অতীতে যেভাবে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয়ে এসেছে, রাজনীতি যেভাবে চলেছে, সেই ধারার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ ৫ আগস্ট–পূর্ববর্তী ধারার সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে নতুন স্রোতোধারা তৈরি করতে হবে।

আগের নিয়মে রাজনীতি চলতে থাকলে মানুষের লাভ কী হবে? কয়েক বছর পরপর একটা বড় আন্দোলন হবে, অভ্যুত্থান হবে, মানুষেরা প্রাণ দেবে। তারপর আবার থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাঁরা খুব ক্ষমতাপ্রতাশী তাঁরা অহরহ বলছেন, এই সরকারের তো সংস্কার করার ম্যান্ডেট নেই, তাদের কাজ হলো নির্বাচন দেওয়া। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরকারের তো নির্বাচন দেওয়ারও ম্যান্ডেট নেই। মানুষ কী চায়, সেটা সরকারকে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পড়তে জানতে হবে। মানুষ কী চায়, সেটা রাজনৈতিক দলগুলো পড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা কিছুই শিখছে না। মানুষের আকাঙ্ক্ষা যে কোথায় চলে গেছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো তাল মেলাতে পারছে না।

নির্বাচনের জন্য বিএনপির অপেক্ষা করার কথা। কারণ, সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা তারা দেখাতে পারেনি। এখানে দুটি উদাহরণের কথা বলতে পারি। ২০১৮ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হলো, সেদিন বিনা বাধায় পুলিশ তাঁকে কারাগারে নিয়ে যায়। গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপি যে মহাসমাবেশ করেছিল, সেখানে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড মেরে নয়াপল্টন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বিএনপির সমাবেশে যে জনসমাগম হয়েছিল, সেটা কিন্তু কম ছিল না।

রাজনৈতিক দলগুলোর কপাল ভালো যে ছাত্রদের আন্দোলন সর্বস্তরের জনতার সমর্থনে একটি পরিণতির দিকে গেছে। এখন দেশে একটা খোলা হাওয়া বইছে। সবাই যার যার কথা বলতে পারছে। একটা বিষয় তাদের বোঝা দরকার যে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে জুলাই–আগস্টের আন্দোলন হয়নি। রাজনৈতিক দলের ব্যানারে হলে সেটা কোনো দিনই সফল হতো না।

নির্বাচন নিয়ে আমাদের অনেক ভাবনাচিন্তা করা দরকার। সংস্কারের যে কথাগুলো আসছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি লাগবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য যে কমিশনগুলো করা হয়েছে, তারা প্রতিবেদন দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। এরপর এমনিতেই নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ বেরিয়ে আসবে। এটার জন্য এত হা–হুতাশ কেন?

এ দেশে জনগণের স্বার্থে, জনগণের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য রাজনীতি কেউ করে না। এখানে সবারই গোষ্ঠীগত এজেন্ডা আছে। তারা সেই পথেই এগোবে। আমরা ৫৩ বছর ধরে শুনে আসছি, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পক্ষে কথা বলে। তারা আসলে নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে, দলের স্বার্থে, দলের নেতার স্বার্থে কথা বলে।

আমাদের এখানে রাষ্ট্র ও জনগণ—এ দুয়ের মধ্যস্বত্বভোগী হলো রাজনৈতিক দল। মধ্যস্বত্বভোগী শব্দটা আমি নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক কোনো অর্থে বলছি না। এটা হলো বাস্তবতা। প্রতিটি রাজনৈতিক দল একেকটা সিন্ডিকেট। যে দল যত বড়, তাদের সিন্ডিকেট তত বড়।

আমরা পাঁচ বছর, দশ বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই, এ বিষয়ে জন–আলোচনায় আসা দরকার। রাষ্ট্রটা আমাদের ১৭ কোটি মানুষের। আমরা কোনো গোষ্ঠী কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের রাষ্ট্রটাকে আবার ইজারা দিতে পারি না।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক