পুতিনের ভুল ও এরদোয়ানের চতুরতা

রাশিয়ার প্রভাব যে হারে কমছে, সেই হারে কূটনৈতিকভাবে সেই জায়গা নিচ্ছে তুরস্ক। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে কেউ যদি বিনা ঝুঁকিতে লাভবান হয়ে থাকে, সেটা হলো তুরস্ক
ছবি : রয়টার্স

ভ্লাদিমির পুতিন, ভলোদিমির জেলেনস্কি ও জো বাইডেন। তিনজনেরই ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, কিন্তু তিন গতিতে। পুতিনের স্পেশাল মিলিটারি অপারেশনের গতিটা ছিল ধীর। এতই ধীর যে মিলিটারি অপারেশন আর ছয় মাসেও শেষ হওয়ার সুযোগ এল না; বরং সেটা এখন ন্যাটো বনাম রাশিয়ার ‘ফুল ভলিউম কনসার্ট’ হয়ে উঠেছে। জেলেনস্কি টিকে থাকছেন প্রতিদিনকার ভিত্তিতে। প্রতিদিন লড়তে পারা মানে আরও এক দিন সুযোগ পাওয়া। যদিও জানেন না কখন কোথায় রুশ মিসাইল এসে পড়বে, কখন রুশ আততায়ী তাঁকে নিশানা করবে। বাইডেনের ঘড়ির গতিও পুতিনের মতোই ধীর। শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে দিয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছিল, ইউক্রেনকেও যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার জন্য ফাঁদ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছিল। পুতিনও সময় নিচ্ছিলেন। কিন্তু খারকিভ থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার ও সেই এলাকায় ইউক্রেনের আপাত বিজয়ে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ বরং দীর্ঘই হতে যাচ্ছে।  

অবশ্য পুতিন বলেছিলেন, তাঁর স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন (এসএমও) দীর্ঘ হবে না। কিন্তু ইতিমধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। তাহলে কি রাশিয়ার পরিকল্পনায় ভুল ছিল? না হলে দুই দফা পিছু হঠতে হলো কেন? এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে কিয়েভের দোরগোড়ায় হানা দিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল রুশ বাহিনী। আর এই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি উত্তর–পশ্চিম ইউক্রেনের খারকিভ থেকেও তড়িঘড়ি করে সৈন্য সরিয়ে নিতে হলো রাশিয়াকে। এ ঘটনায় পশ্চিমা গণমাধ্যমে রাশিয়ার সম্ভাব্য পরাজয়ের আলাপ জমে উঠেছে।

অথচ পুতিন এখনো চাঙা। মধ্যযুগীয় সিল্ক রুটের গঞ্জ-শহর সমরখন্দে মিলিত হয়েছিলেন রুশ, ভারত ও চীনের তিন নেতা। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) নামের চীনা নেতৃত্বের এই আন্তর্জাতিক জোটে সংলাপ অংশীদার তুরস্ক, এবারই পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পেল ইরান। এ সম্মেলনেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধ দ্রুতই শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট কোভিড সময়ের দুই বছর পর এই প্রথম বিদেশ সফর করলেন। পুতিন-সির মধ্যে বন্ধুত্ব কতটা, তা এই বাক্যেই বোঝা যায়। সি বলেছেন, ‘ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়াকে ঘায়েল করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়া যুদ্ধের ময়দানেও তুরস্ক আগের চেয়ে প্রভাবশালী হয়েছে। কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। কৃষ্ণসাগরে তুরস্কের স্বার্থ আর রাশিয়ার স্বার্থের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। এই চিন্তা থেকে কৃষ্ণসাগরপারের ইউক্রেন, আজারবাইজান, জর্জিয়া, মলদোভা ও রোমানিয়া তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য আরবের চাইতে বলকানের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল।

মাঠের চিত্র বলছে, আসল যুদ্ধ সম্ভবত খারকিভ থেকেই শুরু হলো। এখন থেকে এটাকে আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বলা ঠিক হবে না। এই যুদ্ধের সত্যিকার পক্ষ এখন ন্যাটো বনাম রাশিয়া। শুরু থেকে এই কথাই অনেক আলোচকই বলে আসছিলেন। খারকিভে ন্যাটো তার সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখেছে। ইউক্রেনের খারকিভ বিজয়াভিযানে ন্যাটো পুরোমাত্রায় জড়িত ছিল। বিপুল অস্ত্র সরবরাহ এবং গুরুতর গোয়েন্দা তথ্য তো ছিলই। খারকিভ অভিযানে প্রতি তিনজন ইউক্রেনীয় ইউনিফর্ম পরিহিতের মধ্যে একজন ছিলেন ন্যাটো দেশের সেনা। সাবেক মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা অধ্যাপক মাইকেল ক্রেইগ রবার্টস তাঁর লেখায় এ তথ্য দিয়েছেন।

কিন্তু পুতিন কি তা জানতেন না? গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা ভ্লাদিমির পুতিনকে এখন স্বীকার করতেই হবে, রাশিয়ার গোয়েন্দা তথ্যে ভুল ছিল। ইউক্রেনের রুশভাষীরা রাশিয়ার বাহিনীকে প্রত্যাশামতো স্বাগত জানাননি। কিয়েভ থেকে জেলেনস্কিকে সরানো এবং ইউক্রেন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও তাদের ন্যাটো প্রশিক্ষকদের নির্মূল করাই ছিল রাশিয়ার ঘোষিত লক্ষ্য। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা রুশ হুমকিতে ভয় তো পানইনি, উল্টো ন্যাটোর সাহায্যে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ছয় মাস দীর্ঘ প্রতিরোধ জারি রাখতে পারাও ইউক্রেনের জন্য মর্যাদাজনক। দিনের শেষে আগ্রাসনকারীদের চাইতে মুক্তিকামীদের নৈতিক মনোবল বেশি থাকে।

যা হোক, এসব থেকেই প্রশ্ন উঠেছে যে রাশিয়া আসলে কী চেয়েছিল? কতগুলো প্রশ্নের উত্তর মেলে না: ১. কেন রাশিয়া তার এয়ার পাওয়ার থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেনে ন্যাটোর অস্ত্র সরবরাহ লাইন চালু থাকতে দিয়েছে? ২. কেন ইউক্রেনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে যেতে দিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাজ চালানোর সুযোগ দিয়েছে? ৩. যদি ইউক্রেন দখলই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেন পূর্ণাঙ্গ শক্তি প্রয়োগ না করে চেচেন বাহিনী দিয়ে কাজ চালাতে হলো এত দিন? ৫. কী দিয়ে রাশিয়া তার জয় পরিমাপ করবে? দোনেৎস ও লুহানস্ক, ‍ওদেসা ও ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করা, নাকি জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনীয় শাসকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে সমগ্র ইউক্রেন দখলে রাখা?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নটি যে সঠিক, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। খারকিভ থেকে সরে আসার পর রাশিয়ার মিসাইল মোটামুটি অর্ধেক ইউক্রেনের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট উড়িয়ে দিয়েছে। আগে এটা না করার কারণ কি পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখা? রাশিয়াও কি ন্যাটোর মতো করে ভেবেছিল যে ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়িয়ে ও আটকে দর-কষাকষির পাল্লা ভারী করা? আর শেষ প্রশ্নটির উত্তর এখন মোটামুটি জানা। রাশিয়াও স্বীকার করবে যে পুরো ইউক্রেন দখল করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

রাশিয়ার জন্য জয় যতটা কঠিন, ন্যাটোর পক্ষে রাশিয়াকে ইউক্রেনে হারানোও ততটাই কঠিন। সামনে ইউরোপে শীত আসছে। রুশ গ্যাস ছাড়া ইউরোপ জমে যাবে। শীতের আতঙ্ক ও জ্বালানিসংকট ইউরোপকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আরও গভীরে নিতে পারে। পশ্চিমা ফ্রন্টে বিভক্তিও আসতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক বলছে, মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপের জন্য বিশ্বজুড়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে; অর্থাৎ পাশ্চাত্যের রাশিয়া অবরোধ খোদ পাশ্চাত্যের জন্যই বুমেরাং হয়ে ফিরছে।

তাই ন্যাটো চাইবে দ্রুতই ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত হোক। কিন্তু পারমাণবিক বোমার হুমকির জন্য তারা সরাসরি জড়িত হতে পারছে না। আর রাশিয়ার বিশাল সামরিক শক্তি ইউক্রেন ফ্রন্টে বিজয়ের জন্য যদি মরিয়া হয়, সেটা সামাল দিতে কি পারবে পাশ্চাত্য? নিজেদের সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও দীর্ঘদিন ইউক্রেন নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগ তাদের নেই। ইউক্রেনীয় বাহিনী যত দিন সাফল্য পাবে, তত দিনই অস্ত্র ও মদদ আসবে। একবার তারা যুদ্ধের শুরুর সময়ের মতো হারতে থাকলে দুনিয়ার মনোযোগ কমতে থাকবে। পুতিন যদি এই যুদ্ধ থেকে সম্মান বাঁচিয়ে বেরোতেও পারেন, তিনি দেখবেন, প্রতিবেশীরা রাশিয়াকে ভয় পাচ্ছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো আরও রাষ্ট্র ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছে এবং এ-ও হয়তো দেখা যাবে, বলকান অঞ্চলে

রাশিয়ার প্রভাব যে হারে কমছে, সেই হারে কূটনৈতিকভাবে সেই জায়গা নিচ্ছে তুরস্ক।
ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে কেউ যদি বিনা ঝুঁকিতে লাভবান হয়ে থাকে, সেটা হলো তুরস্ক। আর্মেনিয়া শত্রুতা ভুলে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছে। অন্যদিকে আজারবাইজান তো তুরস্কের প্রতি নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধজয়ের জন্য কৃতজ্ঞই আছে। আর্মেনিয়া ও তুরস্ক পরস্পরের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার চুক্তি করেছে, পরস্পরের বিমানবন্দর ব্যবহারে রাজি হয়েছে। ইউক্রেনীয় খাদ্যশস্য রপ্তানিতে মধ্যস্থতা এবং তুর্কি ড্রোন বিক্রির মাধ্যমে ইউক্রেনের আস্থা অর্জন করেছে তুরস্ক। যদিও রাশিয়ার সঙ্গেও তার দেওয়া-নেওয়া আছে। তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেনি।

রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়া যুদ্ধের ময়দানেও তুরস্ক আগের চেয়ে প্রভাবশালী হয়েছে। কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। কৃষ্ণসাগরে তুরস্কের স্বার্থ আর রাশিয়ার স্বার্থের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। এই চিন্তা থেকে কৃষ্ণসাগরপারের ইউক্রেন, আজারবাইজান, জর্জিয়া, মলদোভা ও রোমানিয়া তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য আরবের চাইতে বলকানের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল।

তাই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া যদি থমকে যায়, অন্ততপক্ষে বলকান ও ককেশীয় অঞ্চলে তার প্রভাব খর্ব হয়, সেই জায়গা নিতে চতুরতার সঙ্গে কাজ করছেন তুরস্কের ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড় এরদোয়ান।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক
faruk.wasif@prothomalo.com