প্রথম শতকের গ্রিক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক প্লুতার্ক লিখেছিলেন, ‘রাষ্ট্র যখন প্রবীণ শাসকদের কারণে সমস্যায় পড়ে বা প্রচণ্ড আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়, তখন প্রবীণদের রাজনীতিতে থাকা ঠিক হবে কি না, তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
প্লুতার্ক বিশ্বাস করতেন, বয়সের মধ্য দিয়ে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতাসঞ্জাত মানসিক দৃঢ়তা শুধু প্রবীণ ব্যক্তিরাই অর্জন করতে পারে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে রাষ্ট্র সব সময় প্রবীণ রাজনীতিকদের পরিত্যাগ করে, সেখানকার রাজনীতি অনিবার্যভাবে খ্যাতি ও ক্ষমতার জন্য লালায়িত যুবা শ্রেণির দ্বারা পূর্ণ হবে।
একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের যে প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি থাকা দরকার, তা সেই তরুণ নেতাদের মধ্যে থাকে না।
প্লুতার্ক যদি এখন বেঁচে থাকতেন এবং গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে অনুষ্ঠিত টিভি বিতর্কে জো বাইডেনের বিপর্যয়কর পরাজয় দেখতেন, তাহলে কী বলতেন?
প্লুতার্ক যদি বিতর্কে পরাজয়ের পরও নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী থাকার বিষয়ে বাইডেনের গোঁ ধরে থাকা দেখতেন, তাহলে তিনি কী বলতেন?
প্লুতার্ক হয়তো তাঁর পুরোনো যুক্তিগুলোই তুলে ধরে বলতেন, বৃদ্ধরা দুর্বল হতে পারে, কিন্তু তাঁদের শারীরিক দুর্বলতার কারণে যতটুকু সমস্যা তৈরি করে, তার চেয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার কারণে তার তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে।
তবে বাইডেন সম্পর্কে প্লুতার্কের চিন্তাভাবনা যা–ই হোক না কেন, তিনি সম্ভবত সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশ্বের বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে পারতেন না।
এমন নয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানো এই দুই ব্যক্তিই (যাঁদের একজনের বয়স ৮১ বছর এবং একজনের বয়স ৭৮ বছর) শুধু বয়স্ক রাজনীতিক। দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার অন্য আইনপ্রণেতারাও ‘ধূসর’ হয়ে গেছেন।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের গড় বয়স ৫৮ বছর এবং সিনেটের সদস্যদের গড় বয়স ৬৫ বছর। সিনেটরদের তিন ভাগের এক ভাগের বেশির বয়স ৭০ বছর বয়সের বেশি।
শুধু যে আমেরিকাতেই বুড়োদের শাসন চলছে, তা নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও বয়স ৭১। ভারতের নরেন্দ্র মোদির বয়স ৭৩ বছর।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ মোদির চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বয়স ৭৪ বছর।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতা মাহমুদ আব্বাসের বয়স ৮৮ বছর। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বয়স ৮৫ বছর।
এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক বিশ্বনেতা হলেন ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া। তাঁর বয়স ৯১ বছর; অর্থাৎ বাইডেনের চেয়ে তিনি মাপা এক দশকের বড়।
তবে বিশ্বে এখন তরুণ নেতৃত্ব যে একেবারে নেই, তা নয়। অবশ্যই তরুণ নেতারা আছেন।
ফ্রান্সে গ্যাব্রিয়েল আটাল বিশ্বের এই সময়ের সবচেয়ে কম বয়সী (৩৫ বছর বয়সী) প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনি হয়তো খুব অল্প দিনই এই পদে থাকবেন।
দেশটির কট্টর ডানপন্থী নেত্রী জর্দান বারদেলার বয়স মাত্র ২৪ বছর। তিনিও নতুন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। চরম ডানপন্থীরা দ্বিতীয় দফার ভোটে হেরে যাওয়ায় তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়নি।
সব মিলিয়ে বুড়োদের শাসন সমসাময়িক বিশ্বের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্লুতার্কের আশঙ্কা ছিল, তরুণেরা ক্ষমতার আসনে বসলে বাঁধভাঙা বানের পানির মতো অনভিজ্ঞ তরুণেরা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং তাঁরা উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের মতো বিভ্রান্তির স্রোতে জনতাকে তঁাদের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাবেন।
প্লুতার্কের সেই দুশ্চিন্তা সম্ভবত এখনো মানুষকে তাড়া করে ফেরে।
যদিও দেখা যাচ্ছে, প্লুতার্ক যে ভয় ধরানো ঘটনাগুলোর কথা বলেছেন, এখন তরুণেরা নয় বরং ‘জনপ্রিয়’ প্রবীণ রাজনীতিকেরাই তা অহরহ ঘটিয়ে চলেছেন।
জাতীয় সমস্যা সমাধানে তরুণদের চেয়ে অভিজ্ঞ রাজনীতিকেরা বেশি সক্ষম—এমন একটি ভাষ্যের প্রতিষ্ঠা প্রবীণ নেতাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সক্ষম করে তুলছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রৌঢ়ত্বের কারণে বাইডেনের সরে দাঁড়ানো উচিত বলে বিভিন্ন মহল থেকে মত দেওয়ার পরও বাইডেন সরে যাবেন না বলে যে গোঁ ধরেছেন, তা সেই ভাষ্যের দৃঢ়তাকে প্রতিফলিত করছে।
● কেনান মালিক অবজারভার-এর নিয়মিত কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত