গরম দিনের চরম কৌতুক

জলবায়ুর পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতা। সমুদ্রের পানির স্তর উঁচু হয়েছে, কক্সবাজারে গেলেই দেখতে পাই, সমুদ্র কত কাছে চলে এসেছে; বাঁধ দিয়েও তাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। বন্যায় মানুষ মরছে ইউরোপে, সাইক্লোনে আমেরিকায়; দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকা-কানাডা। নিউইয়র্ক শহরের রাজপথে গাড়িগুলো কেয়াপাতার নৌকার মতো ভাসছে। বন্যায় লোক মারা যাচ্ছে। দুনিয়া যেন গরম চুলা।

একে তো দুনিয়া গরম, তার ওপরে গাছ কেটে, খাল-বিল-পুকুর-নদ-নদী ভরাট করে আমরা দেশটাকেও বানিয়ে তুলেছি একটা ইটভাটা। ঢাকা শহর তো গনগন করছে।
প্রচণ্ড গরম, অবস্থা চরম! গরমে পিচের রাস্তা নরম হয়ে গেছে, এমনকি নরম হয়ে গেছে রেলের পাত; এঁকে বেঁকে অজগরের আকার নিয়ে কারণ হয়ে গেছে দুর্ঘটনার। মাথা তো আগে থেকেই গরমই ছিল, এখন শরমও যাচ্ছে উঠে। গায়ে কাপড় রাখব কি, মনে হচ্ছে একগলা পানিতে ডুবে বসে থাকি মোষের মতো; পানি না থাকলে কাদাই ঘাঁটব! ঘোলা পানিতে মাছ শিকারটা আবার জমবে ভালো।

গরমে পরম পাওয়া গরমাগরম কৌতুক।

তিন বন্ধু চাপাবাজির প্রতিযোগিতা করছে।

প্রথমজন: আমার দাদার আমলে এমন গরম পড়েছিল যে মুরগি একেবারে সেদ্ধ ডিম পাড়ত।

দ্বিতীয়জন: আমার দাদার আমলে এমন গরম পড়েছিল যে গাইয়ের দুধ আর সেদ্ধ করতে হতো না। গরুর ওলান থেকে হাঁড়িতে পড়ামাত্র টগবগ করে ফুটত।

তৃতীয়জন: আমার দাদার আমলে এমন গরম পড়েছিল যে রাস্তার ধারে খাবারের ভ্যান দিয়ে তিনি বড়লোক হয়ে গিয়েছিলেন।

কী রকম?

তিনি তোদের দাদার কাছ থেকে গরম ডিম আর দুধ এনে ভ্যানে করে বিক্রি করতেন!
গরম কখনো একা আসে না। গরম সঙ্গে করে আনে লোডশেডিং! লোডশেডিং হলে পানির পাম্পগুলো বন্ধ, চলতে পারে না। কাজেই মহল্লাগুলো হয়ে ওঠে কারবালা। খেতের ধান পুড়ে যায়। কৃষকের মাথায় আগুন জ্বলে।

গরমে চাই হিট অফিসার। তাই নিয়ে ফেসবুক সরগরম! কিন্তু গাছকাটা চলছেই। গরম আছে, শরম নাই। ঠিকাদারের এক কথা: মরম না জানে ধরম বাখানে, এমন আছয়ে যারা। কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহন তারা। তুমি কি বুঝবে টাকার মর্ম! নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করতে হবে। হবেই। আমরা গাছ কাটব। তাতে নগর সুন্দর হলো কি হলো না, সেটা বিউটিশিয়ানরা বুঝবেন, আমার পকেট তো ভরল! টাকাই ধর্ম, টাকাই কর্ম, টাকাই পরম তপস্যা। গরমের দেশের এটাই নিয়ম।

সরকার বাধ্য হয়ে ডলার পাঠায় তেল আর কয়লা কিনতে। এ সুযোগে ডলারের আক্রা হয়, এলসি বন্ধ, বাজারে তখন আগুন লেগে যায়! বাজারে গিয়ে ছাগলের দাম দিয়ে ডিম কিনে আনেন কর্তা। ডিম যে এনেছ, ভাজব কী করে, চুলায় গ্যাস কই? ইউটিউবে রোদের তাপে তাওয়া গরম করে ডিম পোচ করতে দেখে কর্তা ডিম আর তাওয়া হাতে গেলেন ছাদে। ডিম কি পোচ হবে, কর্তা নিজেই পোচ হয়ে ফিরে আসেন। তখন তাঁর মুখ দেখবে কে? টাকের ওপরে এসব কী? কাকের...কা কস্য পরিবেদনা! কে কার বেদনা বুঝেছে এ জগতে! একটা ডিমও পোচ করতে পারো না, পারোটা কী! কিছুই পারি না, ক্ষমা করে দাও, মা। মা? গরু হারালে এ রকমই হয়—মা, জল দে মা, ঘটি খাই।

গরমে চাই হিট অফিসার। তাই নিয়ে ফেসবুক সরগরম! কিন্তু গাছকাটা চলছেই। গরম আছে, শরম নাই। ঠিকাদারের এক কথা: মরম না জানে ধরম বাখানে, এমন আছয়ে যারা। কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহন তারা। তুমি কি বুঝবে টাকার মর্ম! নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করতে হবে। হবেই। আমরা গাছ কাটব। তাতে নগর সুন্দর হলো কি হলো না, সেটা বিউটিশিয়ানরা বুঝবেন, আমার পকেট তো ভরল! টাকাই ধর্ম, টাকাই কর্ম, টাকাই পরম তপস্যা। গরমের দেশের এটাই নিয়ম।

যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা তারকা। সেলিব্রিটি। তাঁদের কোনোই দুর্ভাবনা নেই। গরম, তাতে কী! তাঁদের আছে অসংখ্য ফ্যান। কিন্তু আজকাল তো ফ্যান থাকলে চলে না। এসি লাগে! তা-ও আছে। এই ব্যাংকে ওই ব্যাংকে নামে-বেনামে এসি তো আছেই। কারেন্ট এসি, সেভিংস এসি। না, বলছিলাম এয়ারকন্ডিশনারের কথা! তা তো আছেই। আমরা এসি ঘরে কম্বল মুড়ে ঘুমাই। তারপর এসি বাথরুমে স্নান সমাপন করে এসি লিফটে নেমে এসি গাড়িতে করে এসি মাঠে গিয়ে গলফ খেলি! এসি অফিসে বসে থাকি সুট-বুট পরে।

জনগণের খবর আমরা রাখব না তো কী আপনারা রাখবেন! কী করে রাখবেন! আপনারা দুই টাকার হাতপাখা কিনে হাতে ধরে মাথাটা এপাশ-ওপাশ করছেন। না হলে তো পাখার ডাঁটা মট করে ভেঙে যাবে! জনগণের দুঃখ আপনারা কী করে বুঝবেন!

কী বললেন, গরম পড়েছে! বাজারে আগুন লেগেছে! গরম নিয়ে আমাদের কোনো বাস্তব ধারণা নেই! বলছেন কী মশায়! আমাদের পকেট তো গরম! পকেট গরম থাকলে দিল ঠান্ডা। আর কী বলছেন! তেলের অভাব! কী যে বলেন! তেলের নহর বয়ে যাচ্ছে। তেলের কারণে পদতল পিচ্ছিল, পা রাখতে হচ্ছে সাবধানে। তো সাবধান তো থাকতেই হবে। সাবধানের মার নেই।

তবে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগে, তাঁর শেষ অপারেশনের আগে বলে গেছেন, সাবধানের মার নেই, মারেরও সাবধান নেই। ডা. বিধান চন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথকে আশ্বাস দিলেন, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না, অপারেশন ভালো হবে, আমরা সব সাবধানতা অবলম্বন করেছি।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘সাবধানের মার নেই, তবে মনে রেখো, মারেরও সাবধান নেই।’

এরপর তিনি মুখে বলে তাঁর শেষ কবিতাটি রচনা করলেন:
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
...
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

আমরা, পৃথিবীর ৯০ ভাগ জনগণ, অনায়াসে ছলনা সইতে পারি। শান্তির অধিকার তো আমাদেরই। এই গরমে পোড়া টমেটোর মতো বদন নিয়ে আমরা নরমশরম আমপাবলিক ভালো আছি। একটু আগেভাগে পাকব, আর টুপ করে ঝরে পড়ব। রবীন্দ্রোক্ত হে ছলনাময়ী, তোমার কোনো দুর্ভাবনা নেই! তোমার সৃষ্টির পথ তুমি ছলনাজালে আকীর্ণ করে যেতে থাকো!

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক