ভয়াবহ ভূমিকম্প কি এরদোয়ানের ক্ষমতার মুঠি আলগা করে দিল?

এমনকি ভূমিকম্পের আগে থেকেই এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছিল
ছবি : এএফপি

৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথম ও সর্বপ্রথম বিষয় হচ্ছে এটি একটি মানবীয় ট্র্যাজেডি। এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে তুরস্কে ৪৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্যোগে অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি, তার প্রভাব তুরস্কের রাজনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। প্রাথমিক হিসাবে ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।

ভূমিকম্পের মানবীয় ট্র্যাজেডি এবং দীর্ঘ মেয়াদে তুরস্কের জন্য এর ফলাফল কী হতে চলেছে, সেটা নিরূপণ করা আমার জন্য বেশ কঠিন। আমি তুরস্কে রাজনীতি বিষয়ে পণ্ডিত। কিন্তু আমি ভূমিকম্প যে এলাকায় আঘাত করেছে, সেখানেই বেড়ে উঠেছি। ভূমিকম্পে আমি আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধব হারিয়েছি।

এরপরও আমি মনে করি, এ ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কী হবে, সেটা পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এটা শুধু রাজনৈতিক কৌতূহলের কারণে নয়, তুরস্ক কীভাবে এই বিপর্যয় থেকে পুনর্গঠনের পথে এগোবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলায় কতটা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারবে, সে বিবেচনাতেও সেটা করা দরকার।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও আইনসভা নির্বাচন এ বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এমনকি ভূমিকম্পের আগে থেকেই এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছিল। অর্থনৈতিক সংকট ও এরদোয়ানের স্বৈরতান্ত্রিক ধরনের শাসনের ওপর ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে ভোটারদের মধ্যে (বিশেষ করে তরুণ ভোটার) তাঁর জনপ্রিয়তা কমেছে।

ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণে যে রাজনৈতিক বেকায়দায় পড়েছে এরদোয়ান সরকার, তা কাটিয়ে উঠতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাঁর জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি), তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদমাধ্যম এবং সরকারি সংস্থা পরিচালিত মসজিদগুলো খুব দ্রুত ভূমিকম্পকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়’ বলে সংজ্ঞায়িত করে। এর অর্থ হলো, এ ভূমিকম্পে যে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই এরদোয়ানের পক্ষে এড়ানো সম্ভব ছিল না।

এরদোয়ান নিজেই ভূমিকম্পকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বলেছেন, ‘এ ধরনের বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়।’ তিনি এটিকে ‘নিয়তি’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

কিন্তু সমালোচকেরা এতে আশ্বস্ত হতে পারেননি। বিশ্লেষকেরা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকার জন্য এরদোয়ান এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত যে শাসনপদ্ধতি চালু করেছেন, সেটাকে দায়ী করেছেন। ভূমিকম্পের পর সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার জন্যও এ বিষয় দায়ী বলে তাঁরা মনে করেন।

প্রস্তুতি ও সমন্বয়ে ঘাটতি

এ ভূমিকম্পের যে বিশাল ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি, তার জন্য এরদোয়ানকে দায়ী করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০ বছর ধরে এরদোয়ান নির্মাণশিল্পকে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি করে তুলেছেন। তাঁর ক্ষমতার প্রথম দিকে নির্মাণশিল্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিল আমলাতান্ত্রিক ও বেসরকারি সংস্থা। ১৯৯৯ সালে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রলয়ংকর ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর তুরস্কে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

২০১৭ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এরদোয়ান প্রেসিডেন্টশাসিত নতুন যে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যের কোনো বালাই নেই। আমলাতান্ত্রিক সংস্থাগুলো থেকে যোগ্য পেশাজীবীদের তাড়িয়ে সেখানে তাঁর অনুগত ও ক্রনি (স্বজনতোষণ) ঠিকাদারদের নিয়োগ করেন।

এর ফলে এরদোয়ান সরকার নির্মাণ খাতে কোনো ধরনের নিয়ম-বিধি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর পরিবর্তে জনপ্রিয় নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে করের বিনিময়ে লাখ লাখ ত্রুটিপূর্ণ ভবনের মালিককে দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দায়মুক্তি ঘোষণা দেওয়ার সময় এরদোয়ান যে দাম্ভিকতা দেখিয়েছিলেন, সেটি ভাইরাল হয়েছে।

ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযানের ধীরগতি ও সমন্বয়হীনতার জন্যও এরদোয়ান প্রশাসনকে দায়ী করা হচ্ছে।

ভূমিকম্পের পরে উদ্ধার অভিযানের ক্ষেত্রে প্রথম দিনটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই দিনটিতেই পুরো উদ্ধার অভিযান ছিল অকার্যকর। এর পেছনে বিরোধী দলগুলো ও বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা এরদোয়ানের চালু করা কেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। যেমন অনেক সমালোচনা করছেন, দুর্যোগের ভয়াবহতা কতটা, সেটা বোঝার পরও কেন সেনাবাহিনীকে নিয়োগ দিতে দেরি করলেন এরদোয়ান।

সংবাদমাধ্যমের ওপর এরদোয়ানের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও তুরস্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে এসব সমালোচনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে তুরস্কে ৪৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

সাময়িকভাবে টুইটারে প্রবেশের সুযোগ ব্লক করে দিয়ে এবং জনসমক্ষে এই ঘোষণা দিয়ে যে সমালোচনাগুলো তিনি এখন তাঁর ‘নোটবুকে টুকে রাখছেন’, পরে এর বিচার হবে—পরিস্থিতি সামলানোর পথ খুঁজছেন। কিন্তু এ পদক্ষেপ ও হুঁশিয়ারি প্রেসিডেন্টের প্রতি জনগণের ক্ষোভ সামান্যই থামানো যাচ্ছে।

২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত এরদোয়ান স্বৈরশাসক হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন। ভিন্নমতাবলম্বীদের সমালোচনা গ্রহণের চেয়ে তাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেওয়াতেই তিনি মনোযোগী। সে কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এরদোয়ানের রাজনৈতিক আচরণ এখন বদলানোর কোনো সুযোগ নেই।

সে জন্যই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনে নতুন নেতৃত্বকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতের ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য দেশকে ভালোভাবে প্রস্তুত করা যায়।

এরদোয়ান কি নির্বাচন বাতিল করবেন

ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যর্থতা জনমনে যে রোষের জন্ম দিয়েছে, তাতে আসন্ন নির্বাচনে তার প্রভাব কী পড়তে পারে, তা নিয়ে এরদোয়ানের দলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

একেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও তুরস্কের আইনসভার সাবেক স্পিকার বুলেন্স আরিন্স এরই মধ্যে নির্বাচন এক বছর স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী কেবল যুদ্ধকালে নির্বাচন স্থগিত হতে পারে। তিনি বলেছেন, সংবিধান এমন কোনো ‘পবিত্র’ বিষয় নয় যে সেটা অগ্রাহ্য করা যাবে না।

এরদোয়ান এখন বড় ধরনের দ্বিধায় পড়েছেন। পরিকল্পনামাফিক আগামী জুন মাসে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তাঁর হেরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। ভূমিকম্পের আগের জনমত জরিপ বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন এরদোয়ান।

ভূমিকম্পের আগে থেকেই তুরস্ক বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছয় মাস ধরে বার্ষিক মূল্যম্ফীত ৮০ শতাংশের বেশি ছাড়িয়েছে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ছয়টি বিরোধী দল মিলে জোট করেছে। একেপি থেকে নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রীসহ এই জোটে যাঁরা একেপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরাও রয়েছেন।

এসব কারণে অসাংবিধানিক হলেও নির্বাচন স্থগিত করার ধারণা এরদোয়ানের কাছে গ্রহণযোগ্য পথ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বহুমুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে, আগামী বছর সেটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা জানেন না এরদোয়ান। এ বিবেচনায় নির্বাচন স্থগিত করা ঝুঁকিপূর্ণ।

সামনের দিনগুলোয় এরদোয়ানের পক্ষে তার রাজনৈতিক আধিপত্য ধরা রাখা কঠিন। তাঁর ক্ষমতার মুঠি এরই মধ্যে আলগা হয়ে গেছে। সেটা ভূমিকম্পের আগে থেকেই।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

  • আহমেত তে কুরু স্যান দিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক