তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে অবিরাম বোমা ফেলে নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ সেখানে নিহত হয়েছে। এ ঘৃণ্য গণহত্যাকে আরও উসকে দিয়েছে হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে নজিরবিহীনভাবে ৩৮০ কোটি ডলারের জরুরি সামরিক ও সাধারণ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
তড়িৎ গতিতে সেটা দেওয়া হয়েছে। ৭ অক্টোবর চালানো হামাসের হামলাকে ইসরায়েলের ‘নাইন–ইলেভেন’ বলে আখ্যায়িত করা বাইডেনসহ মার্কিন কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য বিবেচনায় নিলে ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের ওপর চালানো দমন–পীড়নের সঙ্গে পশ্চিমের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যোগসাজশ দেখাটা মোটেও অমূলক হবে না।
মুসলমান, আরব ও ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে পীড়ন চালানো ও তাদের ওপর নজরদারির শুরুটা নাইন–ইলেভেন হামলার পর হয়েছে, তা নয়। ২০২১ সালে প্রজেক্ট সাউথের ‘স্পাইয়িং অন দ্য মারজিনস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নজরদারি তৎপরতার ইতিহাস নথিপত্রসহ তুলে ধরা হয়।
সেখানে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই তারা এ চর্চা করে আসছে বলে বলা হয়েছে। ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে যে নকশাকাঠামো দাঁড় করিয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকা লোকজনের ওপর নজরদারিতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে মুখ খোলা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো যে এফবিআই ও অন্যান্য সংস্থার বিশেষ নজরদারিতে থাকবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
নাইন–ইলেভেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র গণনজরদারির যে কাঠামো করেছে, তা নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বিশেষ করে মুসলিম এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের সঙ্গে তারা এমন আচরণ করেছে, যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব নাগরিকের ব্যক্তিগত প্রোফাইল চরম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে। গায়ের চামড়ার রং দেখে, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসী পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে আগেভাগেই নেতিবাচক ধারণা নিয়ে রাখা হয়। ২০ বছর আগের সেই নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরেনি।
ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিমদের পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে ভয়ংকর ভাষ্য দাঁড় করানো হয়েছে। সেই ভাষ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অনেক নাগরিক আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কালোদের জীবনেরও দাম আছে—এই বার্তা দেওয়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন দমানোর ঘটনা তার একটি বড় উদাহরণ। ফ্লোরিডার গভর্নর রন স্যান্টিস ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্রসংগঠন স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইনকে ওই অঙ্গরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নিষিদ্ধ করেছে।
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ লড়াইকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে দেখাচ্ছে এবং এটিকে পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে মুখ খুললেই ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ আনা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের আগ্রাসনের সমালোচনাকে সন্ত্রাসের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সমার্থক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।
তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে বলা হচ্ছে, তাঁরা সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সমর্থক সব ছাত্রছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিষিদ্ধ করা উচিত। গত ২৬ অক্টোবর মার্কিন সিনেটে ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপগুলোকে মিছামিছি ইহুদিবিদ্বেষী সাব্যস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস সচিব গত ৩০ অক্টোবর ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের শার্লটসভিলেতে সমাবেশ করা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মতো উগ্র গ্রুপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগে বাইডেন নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মধ্যপ্রাচ্য সংকট প্রসঙ্গে বলেছেন, কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ‘অভ্যন্তরীণ হুমকি’ মোকাবিলা করতে সচেষ্ট আছে। এই অভ্যন্তরীণ হুমকি বলতে তিনি যে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনকর্মীদের বুঝিয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ লড়াইকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে দেখাচ্ছে এবং এটিকে পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে মুখ খুললেই ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ আনা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের আগ্রাসনের সমালোচনাকে সন্ত্রাসের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সমার্থক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
আজাদেহ শাহশাহানি গবেষণা সংস্থা প্রজেক্ট সাউথ–এর লিগ্যাল অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর
জুইলি শিভালকার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি বিষয়ের শিক্ষার্থী