কারওয়ান বাজারের প্রগতি ভবনের সপ্তম তলায় প্রথম আলোর অফিসে ঢুকলেন ভদ্রলোক। গায়ে অতি সাধারণ একটি পাঞ্জাবি, পরনে মলিন লুঙ্গি, গলায় মাফলার প্যাঁচানো, মাথায় টুপি, পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। এসেছেন কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের কাছে।
অতিথির জন্য নির্ধারিত জায়গায় তাঁরা খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। একপর্যায়ে সোহরাব ভাই আমাদের সবাইকে ডাকলেন। গেলাম। সোহরাব ভাই বললেন, ‘এনাকে চেনেন?’
সলজ্জভাবে না সূচক মাথা নাড়ানোর পর তিনি বললেন, ‘উনার নাম গাজী কামাল হোসেন। উনি নিজের জায়গা বেচে সেই টাকা দিয়ে রাস্তা বানিয়েছেন। উনাকে নিয়ে প্রথম আলোতে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল।’ এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ‘ও আচ্ছা! আপনিই সেই গ্রেট কামাল ভাই!’ বলে সম্ভাষণসুলভ অভিব্যক্তিতে গাজী কামাল হোসেনের দিকে চাইলাম। তিনি হাসি হাসি মুখে হাত মেলালেন। অনেকক্ষণ আলাপ হলো।
আলাপে উঠে এল গাজী কামালের নিজের কথা, তাঁর মায়ের কথা, স্ত্রী-সন্তানদের কথা। তবে তাঁর রাস্তার আলাপ সব আলাপকে ছাপিয়ে গেল। ‘বরিশাইল্যা’ উচ্চারণে বলা তাঁর গল্প থেকে জানা গেল, তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামে। পেশায় কৃষক। সামান্য জমি আছে। শাকসবজির চাষ করেন। গরু-ছাগল পালন করেন। মাঝে মাঝে সাগরে মাছ ধরতে যান। দুই ছেলের একজন ঢাকায় একটি কোম্পানির বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে থাকা ভ্যানের চালক হিসেবে কাজ করেন। আরেক ছেলে গ্রামে থেকে পড়াশোনা করে।
গাজী কামাল বললেন, তিনি একদিন গ্রামের ভেতর দিয়ে বানানো ছোট রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, এক গর্ভবতী মাকে একটা ভ্যানে করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। ছোট ও এবড়োখেবড়ো রাস্তা থেকে আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভ্যানটি হঠাৎ বিলের মধ্যে উল্টে পড়ে গেল। সেখানেই ওই গর্ভবতী মায়ের সন্তান প্রসব হয়ে গেল।
এই বর্ণনা দেওয়ার সময় গাজী কামালের কণ্ঠ অস্ফুট কান্নায় আটকে যাচ্ছিল। তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। তিনি বললেন, ‘এই দৃশ্য দেইখ্যা আমার খুবই খারাপ লাগল। তহনই আমার মনে রাস্তাডা ঠিকঠাক করার চিন্তা আসল।’
গাজী কামাল বললেন, বাড়িতে ফিরে তিনি তাঁর চলৎশক্তিহীন অশীতিপর বৃদ্ধা মা ফুলবানু বেগমকে ঘটনা বললেন। তাঁর মা তাঁকে বললেন, ‘আইজ যদি তোর বাপ বাইচ্যা থাকত, আর শক্ত কোনো রোগব্যাধিতে পড়ত, তাইলে তুই কি তার চিকিশস্যা না করায়ে পারতি? জমি বেইচ্যা অইলেও তো চিকিশস্যা করান লাগত।’ তিনি ছেলেকে জমি বিক্রি করে রাস্তা করার আদেশ দিলেন।
গাজী কামাল জানালেন, মায়ের আদেশের পর তিনি আর দেরি করেননি। নিজের ৩০ শতাংশ ফসলি জমি ৭ লাখ টাকায় বেচে তিনি ১ হাজার ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের, ১৪ ফুট প্রস্থের এবং ১৪ ফুট উচ্চতার গ্রামীণ রাস্তাটি বানিয়েছেন। এটি আসলে শুধুই রাস্তা নয়। এটি বাঁধও। এই বাঁধ না থাকার কারণে জোয়ারের পানি ঢুকে সব তলিয়ে যেত। মানুষের ভোগান্তি বাড়ত।
কুমিরমারা গ্রামে প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়। উপজেলার মানুষের সবজির একটা বিরাট চাহিদা পূরণ হয় এ গ্রাম থেকে। কিন্তু এই রাস্তা না থাকায় সবজি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতো। বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ এই পথসহ কুমিরমারা গ্রামটি আন্ধারমানিক নদের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেত। চাষাবাদ ব্যাহত হতো। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চলাচলে অসুবিধা হতো। এখন এই রাস্তার কারণে সেই অসুবিধা আর থাকছে না।
গাজী কামাল জানালেন, জমি বিক্রি করে পাওয়া সাত লাখ টাকায় কাজ শেষ করা যায়নি। মা ফুলবানু বেগমের পরামর্শ চাইতে গেলে তিনি ছেলেকে তাঁর (গাজী কামালের) পালন করা একটি গরু বিক্রি করে দিতে বলেন। ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় গরুটি বিক্রি করে সেই টাকাও তিনি রাস্তার কাজে ঢেলেছেন।
তবে কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। বর্ষার মৌসুম আসছে। সে সময় পানির চাপ অনেক বাড়বে। যদি রাস্তার দুই পাশের পানি যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আবার রাস্তাটি ভেঙে যাবে। সে কারণে এ রাস্তার মাঝখান দিয়ে এখন পানিনিষ্কাশনের কালভার্ট বা জলকপাট করে দিতে হবে।
গাজী কামাল জানালেন, তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁর অক্ষরজ্ঞানহীন মা ফুলবানু সেই প্রতিবেদনে হাত বুলিয়েছেন। ছেলের খবর ছাপা হওয়া কাগজে চুমু খেয়েছেন। তিনি নিজের পোষা তিনটি মুরগি ৯০০ টাকায় বিক্রি করিয়ে ঢাকায় যাওয়ার রাহাখরচ হিসেবে ছেলের হাতে দিয়ে বলেছেন, ‘যারা এই খবর ছাপছে, ঢাকায় যাইয়া তাগো ধইন্যবাদ দিয়া আয়।’ সেই ‘ধইন্যবাদ’ দিতে গাজী কামাল শনিবার রাত ১১টায় কুয়াকাটা থেকে বাসে উঠে রোববার ভোরে ঢাকায় নেমেছিলেন। সকালে কারওয়ান বাজারে মসজিদের কাছে এসে প্রথম আলোর অফিস খোলার অপেক্ষায় বসেছিলেন।
বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করলাম, গাজী কামাল দীর্ঘ আলাপের মধ্যে একবারও নিজের অভাব, অভিযোগ, সাংসারিক অনটনের প্রসঙ্গ নিজ থেকে বলেননি। তিনি বারবার যে অভাব-অনটনের কথা বলছিলেন, তা তাঁর নিজের এলাকার মানুষের সামগ্রিক অভাবের কথা। তিনি বলছিলেন, তাঁর গ্রাম উপকূলবর্তী হওয়ায় পানি লবণাক্ত। সুপেয় পানির বড় অভাব। একমাত্র গভীর নলকূপের পানিই খাওয়া যায়। কিন্তু এখানকার মানুষ এতই গরিব যে সেখানে গভীর নলকূপ বসানোর আর্থিক সামর্থ্য কারও নেই। তাঁর এই কথা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁকে একটি গভীর নলকূপের খরচ দিয়েছেন।
কিন্তু বড় সমস্যাটি রয়েই গেছে। সেটি হলো রাস্তার জলকপাট। বর্ষা আসার আগে সেটি করতে না পারলে রাস্তা হুমকির মুখে পড়বে, সেই চিন্তা গাজী কামালের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
জনগণের রাস্তা বানানোর সরকারি টাকা মেরে দিয়ে নিজের জমাজমির পরিমাণ বাড়ানো যে দেশে অতি স্বাভাবিক ঘটনা; সে দেশে নিজের জমি বেচে পরের জন্য রাস্তা বানানো মানুষের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
সত্যি সত্যি অনেকে শুরুর দিকে গাজী কামালের কাজকে পাগলামি বলেও ছিলেন। তাতে তাঁর অবশ্য কিছু যায় আসেনি। ‘ম্যাডনেস ইজ দ্য গ্লোরি অব লাইফ’—এই সুপার রোমান্টিক কথাটির অর্থ হয়তো তিনি জানেন না, কিন্তু তাঁর মর্মবাণী তিনি যে ধারণ করেন, তা একেবারেই স্পষ্ট। কারণ, এই ধরনের ‘পাগলামি’ তিনি যে এবারই প্রথম করেছেন, তা নয়। এর আগে ২০০৭ সালে নিজ অর্থায়নে নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে কুমিরমারা খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছিলেন। ৩৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরি করতে তখন তাঁর দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছিল।
এই বিশাল হৃদয়ের অসীম ধনে ধনী মানুষটি যখন কথা বলছিলেন, তখন হাওর ও উপকূলের লাখো মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে সেখানকার বাঁধের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে সেই টাকায় উঁচু উঁচু ভবন বানানো নেতা, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের গরিবস্য গরিব, ফকিরস্য ফকির মনে হচ্ছিল
এই বিশাল হৃদয়ের অসীম ধনে ধনী মানুষটি যখন কথা বলছিলেন, তখন হাওর ও উপকূলের লাখো মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে সেখানকার বাঁধের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে সেই টাকায় উঁচু উঁচু ভবন বানানো নেতা, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের গরিবস্য গরিব, ফকিরস্য ফকির মনে হচ্ছিল।
পুনশ্চ: গাজী কামাল হোসেনের বানানো রাস্তাটি বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে একটি কালভার্ট নির্মাণ জরুরি। রাস্তার দুই পাশ যাতে ধসে না পড়ে সেজন্য বিশেষ ধরনের গাছ লাগানো দরকার। এই খরচের টাকা তাঁর হাতে নেই। তিনি চিন্তিত, তবে হতাশ নন। অনেকে তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ চাইলে আর্থিকভাবে অংশ নিতে পারেন।
বিকাশ নম্বর: 01785551110 (গাজী কামাল হোসেন)
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com