বেসরকারি খাতের জন্য যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন একটা মূল দাবি ছিল—সেন্ট্রালাইজ পেনশন। কিন্তু সরকার নিয়ে এল নামে সর্বজনীন পেনশন স্কিম, যা আসলে আরেকটা নতুন স্ক্যাম। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত ‘পেনশন সবার জন্য লাভজনক করার ইচ্ছা কি সরকারের আছে’ লেখায় আমি ফিন্যান্সিয়াল হিসাব করে যখন ধরিয়ে দিলাম যে এটায় আসলে মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সুযোগ বেশি, তখন আমার বিরুদ্ধে নানা জায়গায় অভিযোগ ওঠে আমি অপতথ্য ছড়াচ্ছি। যদিও এ অভিযোগের পেছনে কেউ যুক্তি দিয়ে আমাকে ভুল ধরিয়ে দিতে পারেনি।
অর্থ উপদেষ্টার মুখে পেনশন স্কিমের সংস্কারের কথা শুনে আবার নতুন করে আশা পেলাম। এই স্কিম যদি সংস্কার করতে হয়, তাহলে সবার আগে তা সর্বজনীন করতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। সরকারি কর্মচারীদের এই স্কিমের বাইরে রেখে কখনোই তা অন্যদের জন্য সুফল আনতে পারবে না। এভাবে চিন্তা করেন, আমার ট্যাক্সের টাকায় যাঁদের বেতন হয়, তাঁরা আমার ট্যাক্সের টাকাতেই পেনশন নেবেন। কিন্তু আমি ট্যাক্সও দেব, নিজের পেনশনের জন্য টাকাও দেব! সবাই কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ দেয়, কিন্তু এ ব্যাপারে আমলারা বড়ই অনুদার।
প্রথমত, দেশের জন্য সব দ্বৈত আইন বাতিল করতে হবে। বাস্তবে রিটায়ার বেনিফিট মূলত তিন রকম—প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন। আর সবার জন্য প্রযোজ্য হেলথ ইনস্যুরেন্স।
সরকার কি নিজের পকেট থেকে সবাইকে সাহায্য করতে পারবে? অবশ্যই না। তাহলে? এখানেই আসে বেসরকারি খাতের আইন প্রণয়ন এবং সেই আইন হতে হবে সর্বজনীন। দেশে যে কেউ ইচ্ছা করলেই কোম্পানি খুলতে পারে, কিন্তু মানুষকে সুবিধা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো কোনো কোম্পানি প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি দিচ্ছে। বেশির ভাগই দিচ্ছে না। এটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোম্পানি খুলতে হলে তোমার চাকরিজীবীদের সুযোগ নিশ্চিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। সহজ জিনিসকে নিয়মের মধ্যে এনে কঠিন করে কোম্পানি খোলা বন্ধ করতে হবে। একজন কোম্পানি বদল করতেই পারেন; তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি যে কোম্পানিতে চাকরি করবেন, তারা অটোমেটিক দিতে বাধ্য থাকবে, যা মনিটর করবে সরকারের একটা মন্ত্রণালয়। একটা নির্দিষ্ট সময় বা রিটায়ারমেন্টের পর মানুষ সেই টাকা নিতে পারবেন। এখানে সরকারের নিজের কোনো টাকা দিতে হলো না। স্বাস্থ্যবিমাও এ রকম কোম্পানির মাধ্যমে করে দেওয়া যায়। এর ফলে দেশের ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোও দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এখন কেউ অসুস্থ হলেই সবার কাছে হাত পাতছে—এ ধারা বদল হতে হবে।
এখন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কী হবে? তাঁদের বেতন সিটিসি কনসেপ্টে নিয়ে যেতে হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নিজেরা জমা দেবেন, সরকারও দেবে। গ্র্যাচুইটি সিটিসি হিসাবের থেকে জমা হবে। হেলথ ইনস্যুরেন্সও সরকারের করে দেওয়া উচিত, যা অল্প খরচে ভবিষ্যতের বড় খরচ কমিয়ে দেয়। এভাবেই সেন্ট্রালাইজ প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও ইনস্যুরেন্স খুব বেশি খরচ না করেই গড়ে তোলা সম্ভব।
তাহলে পেনশনের কী হবে? এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৮ জন রেজিস্ট্রি করলেও সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্রেশন সমতায়—২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন। কারণ, সমতায় সরকার টাকা দিচ্ছে। এটাই কথা—আমাদের ট্যাক্সের টাকা কোথায় যাবে? আমরা কেন পাব না? সরকারের পেনশন স্কিমে ৮ শতাংশ সুদের ওপর ভিত্তি করে যেখানে ব্যাংকে এখন ১২ শতাংশের ওপর সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এই পেনশন সফল করতে হলে সুদের হার ফ্লোটিং করে যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি সুদ + ১% হার নির্ধারণ করতে হবে। সরকার এই টাকা বিনিয়োগ করে যে মুনাফা পাবে, তার অংশ এখানে দিতে হবে এবং সমতার মতো সরকারকে কন্ট্রিবিউট করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ৭৫ বছরের আগে কেউ মারা গেলে তাঁর সমুদয় টাকা নমিনিকে দিয়ে দিতে হবে। আগের ক্ষেত্রে তা সরকার রেখে দিত।
ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যাফেয়ারের বই ‘পেনশন প্রভিশন: গভর্নমেন্ট ফেইলিউর অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’। সেখানে লেখকেরা দেখিয়েছেন, উন্নত বিশ্বে যেখানে ট্যাক্স থেকে সরকার মানুষকে পেনশন দেয়, তারা বেশ সফল। কন্ট্রিবিউটেড পেনশন (আমাদেরটি কন্ট্রিবিউটেড, সর্বজনীন হয়নি) প্রায় সব দেশেই শুরুতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই হতাশ না হয়ে ভুল থেকে শিখতে হবে।
এখন এই পেনশন স্কিম ঠিক করতে গেলে শুরুতেই আইনের কথা এল। হ্যাঁ, আমাদের বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। টিআইবিও সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতের সংস্কারের কথা তুলেছে। এই দেশে সরকারি ও বেসরকারিদের মধ্যে দ্বৈত আইন আছে। ভারত আইন করে দুই ক্ষেত্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করে ফেলেছে। আমরা সেখানে দুই দিন ছুটিই সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে পারিনি। এই সরকার ভুগছে, সরকারি কর্মচারীরা ঠিকমতো সাপোর্ট দিচ্ছেন না। কিন্তু বেসরকারি খাতের মতো সিস্টেম থাকলে তা সমাধানের জন্য সরকারের খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ সময় লাগত। আবার সরকারি খাতের মতো সুযোগ-সুবিধা থাকলে বেসরকারি চাকরিজীবীরা আরও বেশি পরিশ্রম করতে পারতেন।
এ দেশের একটা বড় সমস্যা ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন না থাকা। ফলে আমলা, একাডেমিশিয়ান ও বেসরকারি খাত এক হয়ে কোনো সমস্যা সমাধানে যেতে পারে না। কিন্তু এই তিন পক্ষ এক হলে যেকোনো সমস্যা সমাধান অনেক সহজ হতে বাধ্য। এই যে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একজনও বেসরকারি খাতের মানুষ নেই। আর বেসরকারি সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারকে তাই যথেষ্টই খাবি খেতে হচ্ছে। আর তাই শুধু পেনশন স্কিম সংস্কার নয়, আসলে দরকার একটা বাস্তবমুখী আইন এবং সবাই মিলে যাতে কাজ করতে পারি, সেই সংস্কৃতি নিশ্চিত করা।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামলেখক
ই–মেইল: contact@subail.com