ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে রাশিয়া গরিব লোকদের ভাড়াটে সেনা হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে—বিষয়টা আমরা মাঝেমধ্যেই পড়ছি। এ চেষ্টা লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা ও এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আপনি যদি এমন কাউকে চেনেন, যিনি এ রকম কোনো পথ খুঁজছেন, দয়া করে তাঁকে বলুন, এ পথে তিনি যেন পা না বাড়ান।
আমরা ইউক্রেনীয়রা আমাদের বাড়িঘর ও পরিবারের জন্য লড়াই করছি। একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যারা অতীতে বহু বছর আমাদের শাসন করেছে, তারা আবার আক্রমণ করার পর এটা আমাদের জন্য অনিবার্য এক বিকল্প। আমরা, ইউক্রেনের জনগণ, এটাকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম বলে মনে করি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের মানুষের সঙ্গে যতটা একাত্ম বোধ করি, সে রকম অন্য কোনো ক্ষেত্রে করি না। সে কারণেই আমি সবার কাছে এ অনুরোধ করছি এই আশায় যেন তাঁরা বুঝতে পারেন, রাশিয়া একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
একটি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার মানে আরেকটি দেশের জনগণকে নিপীড়ন করা। এটা শুধু একজনের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে না, যে টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি পেয়েছিলেন, সেটাও ঝুঁকিতে পড়ে।
গরিব লোকদের একটা সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধ করতে নিয়োগ করা ও তাঁদের যুদ্ধে বাধ্য করা হচ্ছে—এটা দেখা আমার জন্য কষ্টের। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করার সময় তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাঁদের একজনের গল্প আমাকে আবেগতাড়িত করেছে।
ইউক্রেনের পূর্ব দিকের যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিবেকের। তিনি নেপালি নাগরিক। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করার সময় ইউক্রেনেন সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। কারাগারে পাঠানোর আগে আমাদের সেনা ইউনিটকে বিবেককে পাহারা দিয়ে রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
রুশ যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট একটা কর্মপদ্ধতি রয়েছে। তাঁদের কাছাকাছি কোনো শিবিরে পাঠানো হয়। সেখানে দুই দেশের যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁরা।
ইউক্রেনের যেসব নাগরিক রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করেন, তাঁরা আটক হলে তাঁদের জন্য ভিন্ন কর্মপদ্ধতি রয়েছে। তাঁরা বন্দী হলে আদালতে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। সেখানে তাঁরা আইনি সুরক্ষার সুযোগ পান। আদালতই নির্ধারণ করেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় বেইমানি করেছেন, নাকি বাধ্য হয়ে করেছেন।
কিন্তু তৃতীয় কোনো দেশের যুদ্ধবন্দীদের ক্ষেত্রে কী হবে, সেই কর্মপদ্ধতি এখনো পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে শুরুর সময়ে সেটার কোনো কর্মপদ্ধতি ছিল না। বিবেক ছিলেন এ ধরনের প্রথম যুদ্ধবন্দী। সে কারণে আমাদের কর্তৃপক্ষকে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে কয়েকবার ফোন করে নিশ্চিত হতে হয়েছিল, বিবেককে কোথায় স্থানান্তর করা হবে।
ভাড়াটে সেনাদের সচরাচর চেহারার চেয়ে বিবেকের চেহারা ছিল অনেকটাই আলাদা। তিনি ছিলের লাজুক আর শান্ত প্রকৃতির। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সততার সঙ্গে আমাদের তাঁর নাম, পদবি, ইউনিট ইত্যাদি তথ্য বলেছিলেন। বিবেক আমাদের বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এসেছেন; কারণ, মাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর অর্থ দরকার। তিনি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর মা ছিলেন গরিব ও অসুস্থ।
আমাদের বন্দী ছিলেন লম্বা ও সুদর্শন তরুণ। তাঁর চোখগুলো ছিল গভীর কালো। আমার স্মৃতি যদি ঠিক থাকে, তাহলে আমিই তাঁর হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিলাম। আমি বিবেকের জন্য সমবেদনা অনুভব করছিলাম। বিবেকও আমার জন্য সমব্যথী হয়ে উঠেছিলেন। বিবেক ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারতেন। সে কারণে আমরা কথা চালিয়ে যেতে পারছিলাম। বিবেক আমাকে প্রথম যে কথা বলেছিলেন, সেটা হলো, ‘আমি কি এখন বাড়ি ফিরে যেতে পারব?’
বিবেকের কথা শুনে আমি প্রায় কেঁদে ফেললাম। তিনি এমন নিষ্পাপ ছিলেন যে আমার মনে পড়ে তাঁর অনুনয়ের চোখ ও ভিত কণ্ঠের কথা। মনে হচ্ছিল, বিবেক এমনকি এটাও বুঝতে পারছেন না যে ইউক্রেনীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের চোখে তিনি একজন ভাড়াটে সেনা। বিবেক যুদ্ধবন্দী, অথচ তিনি বিশ্বাস করছেন, তিনি এখনই বাড়ি যেতে পারবেন। সম্ভবত বিবেক এটাই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন।
ভাড়াটে সেনাদের সচরাচর চেহারার চেয়ে বিবেকের চেহারা ছিল অনেকটাই আলাদা। তিনি ছিলের লাজুক আর শান্ত প্রকৃতির। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সততার সঙ্গে আমাদের তাঁর নাম, পদবি, ইউনিট ইত্যাদি তথ্য বলেছিলেন। বিবেক আমাদের বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এসেছেন; কারণ, মাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর অর্থ দরকার। তিনি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর মা ছিলেন গরিব ও অসুস্থ।
জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তার কাছে আমি বিবেকের বলা উত্তরগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে থাকাকালেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। খাবার ও পানি ছাড়াও আমি তাঁকে আমার কাছ থেকে প্যারাসিটামল ও আন্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়েছিলাম। তাঁর বাঁ ঊরুতে যে ক্ষত ছিল, সেটার উপশম হবে—এ আশা থেকেই আমি ওষুধগুলো দিয়েছিলাম। অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও আমি তাঁর জন্য সিগারেট কিনে দিয়েছিলাম।
বিবেক আমাকে বলেছিলেন, তিনি শিক্ষার্থী ভিসায় রাশিয়ায় এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কাজ করে যে অর্থ পাবেন, তা তাঁর মাকে পাঠাবেন। তিনি একটা ছোট কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে তাঁকে নগদে টাকা দেওয়া হতো। একদিন তাঁকে আরেকজন নেপালি আরেকটি কাজের প্রস্তাব দিলেন। নিযোগকর্তা তাঁকে বলেছিলেন, মস্কোয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘পাচক’ হিসেবে কাজ করতে হবে। কারখানায় বিবেক যত বেতন পেতেন, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বেতন দিতে চেয়েছিলেন। সে কারণে বিবেক চাকরিটা শুরু করেন।
কিন্তু মস্কোর পরিবর্তে বিবেককে ইউক্রেনের অধিকৃত দোনেৎস্কে পাঠানো হলো। সেখানে তাঁকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিবেকে বলেছিলেন, প্রথম যুদ্ধেই তিনি আমাদের হাতে ধরা পড়েন। এর কারণ হলো, তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ধোঁয়া, চিৎকার ও শব্দের কারণে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ইউনিটটিতে আরও নেপালি ছিলেন। তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তিনি সেটা জানেন না।
যেটা আমাকে সবচেয়ে হতবিহ্বল করেছিল, সেটা হলো আমি বিবেকে প্রতি এক ফোঁটা শত্রুতাও বোধ করিনি। যদিও তিনি আমাদের জন্মভূমিতে এসেছেন টাকার বিনিময়ে আমাদের হত্যা করার জন্য; কিন্তু আমি তাঁকে ভাড়াটে সেনা হিসেবে ভাবতে পারিনি। তিনি ছিলেন আমার ছেলের বয়সী একটা কিশোর, যিনি কিনা ভুল করে ভুল পথে এসেছেন। আমি মনে করি, ভিন্ন কোনো পরিস্তিতি হলে আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে যেতাম।
আমাদের ইউনিটে একজন ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্ট্রান। আমাদের ইউনিটের অন্য সদস্যরা মনে করতেন, শত্রুর প্রতি তাঁরও অনুকম্পা রয়েছে। আমাদের দুজনকে নিয়ে মজার করতেন। তাঁরা আমাদের দুজনকে মজা করে বলতেন ‘মাদার তেরেসা স্কোয়াড’।
কর্তৃপক্ষ আমাদের ইউনিটে এসে বিবেককে নিয়ে যাওয়ার পর কী ঘটেছিল, সেটা আমি জানি না। যাহোক, পরে আমি অনলাইনে একটি ভিডিওতে তাঁকে দেখেছি। আদালতে অন্য ভাড়াটে সেনাদের সঙ্গে বিবেককে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ফুটেজ ছিল সেটি।
বিবেকের সঙ্গে কথা হওয়ার পরই আমি জানতে পারি, বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার লোককে প্রলুব্ধ করে ও নির্যাতন করে কীভাবে রাশিয়া তাদের দেশে নিয়ে আসছে। এসব লোকের বেশির ভাগই এশিয়া ও আফ্রিকার এবং সবচেয়ে গরিব তাঁরা।
তাঁরা অনথিভুক্ত শ্রমিক হওয়ায় তাঁদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। হাসপাতালে চাকরি কিংবা পাচক হিসেবে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের নিয়ে আসা হলেও তাঁদের কামানের গুলির মুখে ফেলে দেওয়া হয়।
তাঁদের অনেকে নিহত হন। অনেকে ভাগ্যবান যে তাঁরা জীবিত ধরা পড়েন। কিন্তু কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হবে তাঁদের।
এসব দেখা বেদনাদায়ক।
যতবার শুনি, রাশিয়া বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো থেকে ভাড়াটে সেনা নিয়োগ দিচ্ছে, ততবারই আমার বিবেকের উজ্জ্বল কালো চোখের কথা মনে পড়ে। আমি তাঁর লাজুক কণ্ঠ শুনতে পাই। আর তাঁর মতো তারুণের করুণ পরিণতির কথা ভেবে দুঃখ বোধ করি।
আরতেম চাপিয়ে ইউক্রেনীয় লেখক ও সেনা
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে