নির্বাচননামা: একটি ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার, আমলা, লেখক ও ছড়াকার মাহবুব তালুকদার গত বছরের ২৪ আগস্ট মারা যান। মৃত্যুর পর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম নির্বাচননামা

নির্বাচনই যে বইটির মূল আলোচ্য বিষয়, নামকরণ থেকেই তা স্পষ্ট। আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ কারণে বইটিতে থাকা তথ্য-উপাত্ত-বিশ্লেষণ, নানা ঘটনার বিবরণ এবং লেখকের অভিজ্ঞতার বয়ানগুলো অনেকের কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক ও ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হতে পারে।

মাহবুব তালুকদার ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান এবং ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করেন।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। এমন সময় তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এ বই পড়লে যেমন বোঝা যায়, তেমনি তাঁর স্বজনেরাও বলেছেন, ক্যানসারের মতো রোগ ও শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে তিনি প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতেন। লেখালেখির সুবিধার জন্য তিনি নির্বাচন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন, চিঠি, তথ্য, উপাত্ত নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন। বইটিতে এর কিছু নমুনাও রয়েছে।

দায়িত্ব পালনকালে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের চেয়ে মাহবুব তালুকদারের ভূমিকা ছিল স্বতন্ত্র ও সাহসী। তিনি নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন, নির্বাচনী ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তিসংগতভাবে তাঁর সত্যকথন ও ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। এ কারণে তাঁর প্রতি গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের বিশেষ আগ্রহ ছিল। এ বইয়েও আগ্রহোদ্দীপক অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, মাহবুব তালুকদার নির্বাচননামায় তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলে ভোটাররা ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ

মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে একাধিক স্থানীয় এবং একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সব কটি নির্বাচন নিয়েই এ বইয়ে তিনি কমবেশি লিখেছেন। তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ নির্বাচন-সংক্রান্ত অধ্যায়ের নাম হলো ‘অনির্বচনীয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: একটি শ্বেতপত্র’।

এ অধ্যায় পড়লে বোঝা যায় ভোটের আগেই নির্বাচন নিয়ে তাঁর প্রশ্ন ও আশঙ্কা ছিল। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বরের ডায়েরির পাতা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আবহ দেখে আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, আমরা সবার প্রতি সম-আচরণ করছি না। যদি আমরা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে না পারি, তাহলে এ ধরনের নির্বাচন কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একেকবার আমার মনে হচ্ছিল, আমি এই পাতানো নির্বাচনের সমগ্র বিষয়টা জাতির সামনে তুলে ধরি। কিন্তু আমি তো কোনো রাজনৈতিক নেতা নই, নিতান্ত নির্বাচন কমিশনার। আমি যা কিছুই বলি না কেন, একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যাওয়ার উপায় আমার নেই।…’

সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচননামাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, নির্বাচন এখন নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চলে গেছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৭ জুলাই ২০২৩)।

মাহবুব তালুকদারের বইটি পড়লে এ বিষয় যে কারোরই বোধগম্য হবে। ২০১৮ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তিনি এ বইয়ে লিখেছেন, ‘...বিগত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকলাপে ধারণা করা যাচ্ছিল, জাতীয় নির্বাচনে তারা কীভাবে কাজ করবে, তার রিহার্সাল দিয়ে নিচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতায় তা একটি সরকারি “নীলনকশা”।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, মাহবুব তালুকদার নির্বাচননামায় তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলে ভোটাররা ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

মাহবুব তালুকদার তাঁর এ বইয়ে নির্বাচনের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, অফিসে গোয়েন্দা তৎপরতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল।…নির্বাচনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িয়ে পড়ছিল।’ একজন নির্বাচন কমিশনার হয়েও তিনি নিজে কীভাবে গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন, এ বইয়ে তার চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। 

দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা

এ বইয়ের ত্রয়োদশ অধ্যায় হলো ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ’। এ অধ্যায় পড়লে রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে মাহবুব তালুকদারের অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এখানে তিনি সংবিধান, গণতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে জাতিকে ঠেলে দেওয়ার নীলনকশাটি কেবল সংবিধানের সংশোধন দিয়ে হয় না। অনেক সময় এটা করতে ছদ্ম গণতন্ত্রের লেবাস পরতে হয়। গণতন্ত্র যখন বিশেষায়িত হয়, তখন বুঝতে হবে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। “উন্নয়নের গণতন্ত্র”, “জনগণের গণতন্ত্র”, “শোষিতের গণতন্ত্র” ইত্যাদি বিশেষণ আক্রান্ত গণতন্ত্র মূলত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পদক্ষেপমাত্র।…’

মাহবুব তালুকদার একসময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নির্বাচননামায় তিনি লিখেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ। পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে, এমনকি সেনাশাসিত সময়ের চেয়ে মিডিয়ার স্বাধীনতা এখন অনেক বেশি সংকুচিত।…’

এ অধ্যায়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করে মাহবুব তালুকদার দেশ নিয়ে তাঁর কিছু আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...মাঝেমধ্যে বিস্মিত হয়ে ভাবি, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ যার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র যা ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ। বাংলাদেশের অনেক অর্জন আজ স্বৈরতান্ত্রিকতায় পর্যবসিত, একজন নাগরিক হিসেবে সেটা মেনে নিতে পারছি না। ভবিষ্যতের ইতিহাস জনগণ না শাসকদের পক্ষে, তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে।’

বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মাহবুব তালুকদারের অভিজ্ঞতা নির্বাচননামার মূল বিষয় হলেও আত্মজৈবনিক ঢঙে লেখা এ বইয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু বিষয়েরও উল্লেখ আছে। অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ এবং বিভিন্ন বিষয়ে সৎ-সাহসী বক্তব্য দেওয়ার জন্য তিনি সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন এবং তাঁকে ‘বিএনপির লোক’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু এ বইটির পঞ্চম অধ্যায় (অসুখ-বিসুখ, বিদেশ সফর ও কিছু স্মৃতিময় সঙ্গ-অনুষঙ্গ) পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি বঙ্গভবনে কাজ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘চাকরিসূত্রে নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে জাতির জনকের সন্তানতুল্য স্নেহ আমি লাভ করেছিলাম। সেটা ছিল আমার ক্ষুদ্র জীবনের বিশাল গৌরবগাথা।’

শেষ কথা

মাহবুব তালুকদার এ বইয়ে লিখেছেন, নির্বাচন কমিশনে তিনি অনেকটাই ‘একা’ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও তিনি তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন করেননি। নির্বাচন নিয়ে নানা অসংগতির ব্যাপারে তিনি তাঁর দায়িত্বের পুরোটা সময় সোচ্চার ছিলেন। সেসব অসংগতির অনেক কিছু তিনি এ বইয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি যেটা সত্য মনে করেছেন, বিরুদ্ধ সময় ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি তা নিয়ে বলেছেন, লিখেছেন। তাঁর এ সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষ তাঁকে সব সময় শ্রদ্ধা ও স্মরণ করবে।

মাহবুব তালুকদার যখন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান এবং বইটি লেখার পরিকল্পনা করেন, ঠিক সে সময়ই তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে বইটি লেখা শেষ করেন এবং এর কিছুদিনের মধ্যে মারা যান। তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছিল, এটা হয়তো তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণে উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, এ বই তাঁর ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’। 

‘ডাইং ডিক্লারেশন’ বা ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’ সাক্ষ্য আইনের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এর মূল কথা হলো, মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষ মিথ্যা বলে না; তাই কোনো ব্যক্তির ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’কে আদালত সাধারণত সত্য হিসেবে বিবেচনা করেন। মাহবুব তালুকদারের নির্বাচননামা আক্ষরিক এবং ভাবগত—দুই অর্থেই একটি ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’। এটি এ বইয়ের গুরুত্বের একটি বিশেষ দিক। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটি পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে এবং আরও হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক