কৃষিকাজে ব্যস্ত গারো নারীরা। মধুপুর, টাঙ্গাইল
কৃষিকাজে ব্যস্ত গারো নারীরা। মধুপুর, টাঙ্গাইল

আইনে কি সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ভূমির অধিকার রক্ষা হচ্ছে

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ সম্পর্কে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী বলেছিলেন, এ আইনের স্লোগান হচ্ছে, ‘দলিল যাঁর জমি তাঁর’। অর্থাৎ শুধু দখল নয়, জমির দলিল–দস্তাবেজ থাকতে হবে এবং এর উদ্দেশ্য হলো, ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণ ও শান্তিপূর্ণ ভোগদখল বজায় রাখা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় অতিবাহিত হলেও আমরা দেশের জন্য সময়োপযোগী, প্রয়োজনীয় ও মানুষের স্বার্থে পূর্ণাঙ্গ ভূমি আইন করতে পারিনি।

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অনুবাদ, সংশোধন, প্রতিস্থাপন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশের ভূমি আইন ব্যবস্থাপনা চলছে। অথচ সীমাবদ্ধ ভূমির বিপুল জনসংখ্যার এ ভূখণ্ডের ভূমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিন্তকরণ এবং সব নাগরিকের সমানভাবে ভূমির মালিকানা ও অধিকার নিশ্চিত করার স্বার্থে যুগোপযোগী ভূমি আইন প্রণয়ন করা ছিল সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ। পূর্ণাঙ্গ ভূমি আইন না হওয়ার সুযোগ নিয়ে কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে কৃষিজমির আশঙ্কাজনক সংকোচন, জলাশয় ভরাট, পাহাড়–টিলা কাটা, বন উজাড়, শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম অঞ্চলেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বা শিল্পায়ন চলছে। দেশে যত মামলা–মোকদ্দমা হয়, তার সিংহভাগই জমিজমা বা ভূমিসংক্রান্ত।

২.

দেশের প্রচলিত ভূমিব্যবস্থা বা প্রয়োজনীয় ভূমি আইন না হওয়ার কারণে সবচেয়ে বড় সমস্যা ও ভোগান্তিতে পড়েছে প্রান্তিক ও পাহাড়ি সংখ্যালঘু জাতিগুলো। ভূমিব্যবস্থার কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগুলো আবারও তাদের পূর্বপুরুষের ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্মুখীন হয়েছে। ঔপনিবেশিক কালের ভূমি রেকর্ডপত্র থেকে দেখা যায় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগ ও ময়মনসিংহের উল্লেখযোগ্য এলাকা খাসি, গারো ও অন্য জাতিগুলোর ছোট ছোট রাজ্য, পরগনা বা এলাকা হিসেবে তাদের অধীনে ছিল।

দখলদার ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ভূমি জরিপের কাজে হাত দেন এবং তাঁদের সুবিধা অনুযায়ী সমতলের ভূমি রেকর্ডের কাজ করেন। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা, কোনো কোনো এলাকায় ভূমির মালিক বা ভূমির সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব, অপ্রতুল লোকবল, সদিচ্ছার অভাবের কারণে পাহাড়ি বনভূমি জরিপের রেকর্ডের বাইরে থেকে যায়।

এ ছাড়া আসাম প্রদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে থাকা সিলেট বিভাগে প্রাথমিক অবস্থায় জরিপ না হওয়া, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধিবিধান জারি হওয়ার কারণে সেখানকার ভূমিব্যবস্থা ভিন্নতা পায়। ফলে এসব পাহাড়ি জনজাতির দলিল নামক বস্তুটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আর সুযোগ ঘটেনি। বস্তুত, তাদের দলিল না পাওয়ার দায়ভার রাষ্ট্রের; তাদের নয়।

৩.

১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশ ভূমির মালিকদের ভূমির অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলেও পাকিস্তান অথবা স্বাধীন বাংলাদেশ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একই সময়ে ব্রিটিশ শাসনাধীন থেকে স্বাধীন হওয়া প্রতিবেশী দেশগুলো পরবর্তীকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছাড়া পাহাড়ি বা অন্যান্য এলাকায় বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিগুলোর প্রথাগত বা ঐতিহ্যগত ভূমিব্যবস্থা বা তাদের জাতিগত ভূমি অধিকার বা উত্তরাধিকার বিধি অনুযায়ী আইন বা সংবিধান প্রণয়ন করলেও বাংলাদেশ সে রকম কোনো আইন করতে পারেনি। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যর্থতা দেখিয়েছি।

রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনী, সংযোজন, প্রতিস্থাপন হলেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিষয়ে কোনো সংশোধনী বা সংযোজন নেই। যদিও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারায় আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর স্বার্থ ও ভূমি অর্থাৎ তাদের পুরুষানুক্রমে ভূমি যেন সুরক্ষিত থাকে, সে বিষয়ে বলা আছে।

এ বিধিতে সরকার সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বার্থ ও ভূমি রক্ষার্থে ব্যবস্থা নেওয়ার এবং ভূমি হস্তান্তরে বাধানিষেধ আরোপের কথা বলেছে। উদ্দেশ্য হলো, সহজ–সরল আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভূমি বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা করা। এ বিধিতে ২২টি জাতির একটি তালিকা রয়েছে, যাদের ভূমি কেবল আদিবাসীদের কাছেই হস্তান্তর করা যাবে। এর অন্যথা হলে রাজস্ব কর্মকর্তার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে।

সংখ্যালঘু জাতিগুলো ভূমি বা জমি কখনো কেনাবেচার বা বন্ধক দেওয়ার পণ্য হিসেবে গণ্য করে না। এটা তাদের জীবন বা অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ভূমি বা বন ঘিরে তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি আবর্তিত হয়। এসব জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার আইন, রীতি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে।

৪.

বস্তুত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পূর্বে ভূমি আইন বলে কিছু ছিল না। এ ভূখণ্ডের হাজার হাজার বছরের মনুষ্যবসতির ইতিহাসে মাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বননীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বন বিভাগের সৃষ্টি ও কার্যক্রম শুরু হয়। উপমহাদেশে ১৯২৭ সালের বন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অ্যাকোয়ার্ড ফরেস্ট বা রিজার্ভ ফরেস্ট কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে সংরক্ষিত বনভূমির সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ, চা ও রবার চাষের ফলে বনবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর পুরুষানুক্রমের ঐতিহ্যগত ভূমি ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বেহাত ও বেদখল হয়ে যায়।

কিছু স্থানে কিছু অবশিষ্ট থাকলেও সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে। পাহাড়ি বনভূমির বাসিন্দাদের অগোচরে, তাদের অন্ধকারে রেখে খুব সহজে কার্যক্রম নেওয়া গেছে। কিছু এলাকায় বন বিভাগের সংরক্ষিত বন সৃষ্টির প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এসব জনগোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠদের আইনি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ের দলিল–দস্তাবেজ এর সাক্ষ্য বহন করছে। তাঁদের সম্মতি ছাড়াই অথবা পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে তাদের নিজেদের পিতৃপুরুষের ভূমিতেই তারা পরবাসী, বর্গাদার বা জায়গিরদার হয়ে পড়ে। অথচ এসব বনভূমির ওপারে লাগোয়া আন্তর্জাতিক সীমান্তের অপর পারে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র বিদ্যমান।

একই জনগোষ্ঠী বা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ভূমির মালিকানা এবং ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত অধিকার সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সুরক্ষিত। নতুন ভূমি সংস্কার আইন ২০২৩–এ শুধু বর্গাদারসম্পর্কিত বিষয়ে বিধিগুলো ১০টি ধারার ৩৮টি উপধারায় বিস্তারিতভাবে সন্নিবেশিত থাকলেও সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ভূমিব্যবস্থার বিষয়ে কোনো ধারা বা বিধি নেই। অথচ ব্রিটিশ শাসকদের সময় আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জনজাতিগুলোর সংস্কৃতি, প্রথা ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান ও অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের ভূমি বেহাত হওয়া থেকে সুরক্ষা রাখার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়ালের মাধ্যমে সেখানকার স্বতন্ত্র শাসনবিধি করা হয়েছিল।

৫.

পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রণীত ভূমি কমিশন আইন ২০০১-এ বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমির বিরোধনিষ্পত্তি বা ভূমি সমস্যা সমাধানে কমিশন পদক্ষেপ নেবে অর্থাৎ সেখানকার জনগোষ্ঠীগুলোর রীতিনীতি ও প্রথা অনুযায়ী ভূমি সমস্যার সমাধান হবে বা ভূমির মালিকানা নির্ধারিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিগুণের অধিক জনসংখ্যার দেশের অন্যান্য অঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও সংখ্যালঘু জনজাতিগুলোর নিজস্ব রীতিনীতি, প্রথা ও জীবন পদ্ধতি আছে। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের খাসিদের প্রথা, রীতিনীতি, জীবনাচরণ, জীবনযাপন পদ্ধতি সবই পাহাড়কেন্দ্রিক। তাদের ভূমির মালিকানাব্যবস্থা তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নারী উত্তরাধিকারী।

সংখ্যালঘু জাতিগুলো ভূমি বা জমি কখনো কেনাবেচার বা বন্ধক দেওয়ার পণ্য হিসেবে গণ্য করে না। এটা তাদের জীবন বা অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ভূমি বা বন ঘিরে তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি আবর্তিত হয়। এসব জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার আইন, রীতি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেশী দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ভূমি মালিকানাব্যবস্থা, ঐতিহ্য ও প্রথাগত, পুরুষানুক্রমের যৌথ মালিকানাব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করলেও আমরা এ সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ধারণা পাই। দেশের পাহাড়ি অঞ্চল বা বনভূমিতে অথবা অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতিগুলোর মূল সমস্যা ভূমির সমস্যা, যে সমস্যা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় বা শাসনব্যবস্থা–সৃষ্ট।

আইন সংস্কারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের বিষয়ে সব সময় প্রশ্ন থেকে যায়। একই রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও একই আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে বাস আর একই নাগরিক অধিকার পাওয়ার অধিকারী হলেও তাদের বিষয়ে কোনো বিধি বা ব্যবস্থা নেই। অথচ দেশের স্বার্থেই, বনভূমি ও পরিবেশ সুরক্ষা করার স্বার্থে এটা করা ছিল খুবই প্রয়োজন। সবার সঙ্গে সমানভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এসব জনজাতির ভূমির অধিকার রক্ষার বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

অথচ সরকারের অ্যাজেন্ডা হলো, দেশে ভূমিহীন হিসেবে কেউ থাকবে না। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা থেকে একই সময়ে স্বাধীনতা লাভকারী প্রতিবেশী দেশে শুধু যে সাংবিধানিকভাবে তাদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমির অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে, তা–ই নয়; প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বনভূমিতে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতির সদস্যদের আইনের মাধ্যমে ভূমির অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের ফরেস্ট অ্যাক্ট ২০০৬–এর কথা বলা যায়।

  • পিডিশন প্রধান সভাপতি, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরাম