বেপরোয়া ছাত্রলীগ, আক্রান্ত তরুণ প্রজন্ম, বিপন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

বাবার ভ্যানে চড়েই গ্রামের বাড়ি ফিরছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন
ছবি : প্রথম আলো

গত কয়েক দশকে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে সমাজে। পরিবারের আয় যতই কম হোক, দারিদ্র্যসীমার যত নিচেই আয় থাকুক, কাজ-আয়-বাসস্থানের যতই অনিশ্চয়তা থাকুক, পরিবার হোক শুধু মানির্ভর, তারপরও দেখা যায় তাঁদের সন্তানেরা পড়ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তাঁদের শেষ ভরসা সর্বজন বা পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানেও যা খরচ, তা কুলানোও অনেকের সাধ্যের মধ্যে থাকে না, বহুজনে কুলাতেই পারে না, ঝরে পড়ে।

ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর-গ্রামে এ রকম বহু শ্রমজীবী নারী-পুরুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য সন্তানদের লেখাপড়া শেখানো। কেউ রিকশা, কেউ সিএনজি, কেউ ভ্যান চালান, কেউ খেতমজুর, কেউ দিনমজুর, কেউ দোকান কর্মচারী, কেউ বাস-ট্রাক শ্রমিক, কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তাঁদের অতিরিক্ত কাজ করতেও কোনো ক্লান্তি নেই, প্রধান প্রেরণা সন্তানের লেখাপড়া।

নিজেরা না খেয়ে, অসম্ভব পরিশ্রম করে, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা না করে, শেষ সম্বল বিক্রি করে, ঋণ করে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান। সব সন্তান এই পরিশ্রমের মূল্য দিতে পারে না, কিন্তু অনেকেই পারে। কোনো কোনো দায়িত্বশীল সন্তান নিজেরা টিউশনি বা খণ্ডকালীন কাজ করেন। এক বেলা খেয়ে, কম খরচ করে নিজের শিক্ষাজীবন শেষ করতে চেষ্টা করেন। কেউ কেউ মা–বাবাকেও কিছু টাকা পাঠাতে চেষ্টা করেন। সে জন্য শ্রমজীবী পরিবারের ঘরে ঘরে এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফুলপরী তাঁদের একজন।

সমাজের এই পরিবর্তন, এই আকাঙ্ক্ষা এবং এই শক্তি সম্ভাবনা বোঝার ক্ষমতা বা রাজনীতি যদি এই দেশের শাসকদের থাকত, তাহলে সর্বজন-শিক্ষা তাঁদের কাছে অনেক গুরুত্ব পেত। পায়নি, বরং অনুপাতে সর্বজন-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কমেছে, ব্যক্তিমালিকানার বাণিজ্যিক মুনাফাসন্ধানী তৎপরতায় শিক্ষা আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। সর্বজনের স্বার্থ গুরুত্ব পেলে শিক্ষা এ রকম নৈরাজ্য আর অবহেলার শিকার হতো না।

ফুলপরীর খবর প্রকাশের কারণে তাঁকে দেখছে মানুষ, পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে, বিচার তদন্ত এগুলোরও কিছু নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এরপর কী হবে? তাঁর তো এসবের মধ্যে যাওয়ারও কথা নয়, তাঁর লেখাপড়া করার কথা। যদি দানবব্যবস্থা অটুট থাকে, তাহলে এই এক ফুলপরী, আরও অনেক ফুলপরী এবং অসংখ্য ছাত্র তাঁদের শিক্ষালাভের নিশ্চয়তা কে দেবে? এ অবস্থা পরিবর্তন করতেই হবে।

শুধু আর্থিক চাপ নয়, এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছাচারিতা। সরকারি ছাত্রসংগঠনের দাপট, নির্যাতনের খেলা, ক্ষমতার বাহাদুরি সবকিছুর চাপ এই অনেক লড়াই করে লেখাপড়া করতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপরই পড়ে। তাদেরই একটি মুখ ফুলপরী। মা-বাবা খুব আদর করে কী সুন্দর একটি নাম দিয়েছেন, আরও ছেলেমেয়েদেরও পড়াচ্ছেন শুধু ভ্যান চালানোসহ নানা শ্রমনির্ভর স্বল্প আয় দিয়ে। কিন্তু প্রথমেই বিশাল আনন্দ আর উদ্দীপনা যে ভয়ংকর আঘাত পেল, তা ফুলপরীর একার অভিজ্ঞতা নয়।

প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের নতুন জীবনে সমর্থন–সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসার কথা অগ্রজদের, তাঁদের যথাযথ তত্ত্বাবধান ও যত্ন নেওয়ার কথা শিক্ষকদের। এর বদলে তাঁদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয় হিংস্র বিকৃতমনা গোষ্ঠীর সামনে, তাঁদের বিকৃত আনন্দ লাভের উপকরণ হিসেবে। গণরুম একটি বড় নির্যাতনকেন্দ্র। গাদাগাদি করে থাকতে হয়।

পড়াশোনার কোনো পরিবেশ নেই, ইচ্ছা ও প্রয়োজনমতো বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই, সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী পোশাকের অনুমতি নেই, ক্লাসের সময়ে কর্তাদের মিছিল বা সমাবেশ থাকলে ক্লাসে যাওয়ার অনুমতি নেই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে গল্প গান আড্ডার অনুমতি নেই। অনুমতি না নিয়ে এই সবকিছু করলে যেকোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। এতসব বিধিনিষেধ, আতঙ্ক আর ক্ষমতার দাপট যেখানে তাকে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলা যায়? কিন্তু এগুলো কারা করে এবং কীভাবে বছরের পর বছর করে যেতে পারে?

আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং সংবাদপত্র, টিভি রিপোর্ট, গবেষণা সব কটি থেকে আমরা সবাই জানি যে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কয়েক বছর ধরে নির্যাতনের কেন্দ্র এবং নির্যাতক তৈরির কারখানায় পরিণত করেছে বর্তমান সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। আমরা এটাও জানি, ছাত্রলীগ যা করছে তা হলো এনএসএফ (জেনারেল আইয়ুব খান), ছাত্রলীগ (আওয়ামী লীগ), জাতীয় ছাত্রসমাজ (জেনারেল এরশাদ), ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের (বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট) ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ এগুলো হলো সরকারি ছাত্রসংগঠনের রোগ!

কিন্তু গত কয় বছরে নির্যাতনে, অপরাধে ছাত্রলীগ আগের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। শুধু তা-ই নয়, আগের সব সরকারের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে তাদের তল্পিবাহী লোকজন ছিল, কিন্তু বর্তমানে যেভাবে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা সরকারদলীয় ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন, তার কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই।

প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের সম্মিলিত ভূমিকায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন বিপন্ন। যে কেউ যেকোনো সময় ছাত্রলীগের যেকোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত, অপদস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত, জখম এমনকি নিহতও হতে পারে। অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। যাঁরা আক্রান্ত হন, জখম অবস্থায় মিথ্যা মামলায় আরেক দফা নির্যাতন ও দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার শিকার তাঁদের অনেকেই। গত কয়েক দিনেই আরও বহুজন নানা মাত্রার নির্যাতনে পড়েছেন, ছাত্রলীগের দীর্ঘ সময় নির্যাতনের কারণে আইসিইউতেও গেছেন দুজন। খুন ও পঙ্গু হয়েই যাচ্ছে।

এই ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরাও তো এই সমাজেরই সন্তান, তাঁদের মধ্যেও খুবই দরিদ্র মা–বাবার সন্তানও আছেন। ভর্তির শর্ত পূরণ করে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তো তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের মা-বাবারা কেউ নিশ্চয়ই সন্তানকে খুনি, নির্যাতক, যৌন নিপীড়ক, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী বা খুন-পঙ্গু হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাননি। তাঁদেরও মেধা ছিল, সম্ভাবনা ছিল, স্বপ্নও নিশ্চয়ই ছিল বড় কিছু হওয়ার। কারা তাঁদের এ রকম পতন ঘটাল, ভাড়াটে কিংবা মাথাছাড়া প্রাণীতে পরিণত করল?

কাদের বাঁশিতে চলছেন তাঁরা? উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথম চোখ যাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের দিকে, যারা চুপচাপ এদের সমর্থন দিয়ে নিজেরা পদ বা আরও কিছু পেতে চায়; এর পরে স্থানীয় সরকারি দলের দখলদার টেন্ডারবাজ লোকজনের দিকে যারা তাঁদের কাজে লাগায়, নিজেদের নানা অপরাধে; শেষে চোখ গিয়ে আটকে যাবে সরকারের বড় কর্তাদের মুখে, যারা এদের লাঠিয়াল বানিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়।

আসলে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সংগঠন হওয়ার কোনো প্রক্রিয়া নেই, এর কমিটি গঠিত হয় ওপর থেকে, ভাঙাও হয় ওপর থেকে, বহু স্থানে কমিটি সদস্য হতে গেলেও টাকা দিতে হয়। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাই তাদের শক্তি। তাদের দায়িত্ব হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন কোনো ভিন্ন কণ্ঠ তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে আতঙ্ক জারি রাখা, এই ক্ষমতা চর্চার পথে নিজেদেরও কিছু অ্যাজেন্ডা তৈরি হয় তাদের!

ফুলপরীর খবর প্রকাশের কারণে তাঁকে দেখছে মানুষ, পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে, বিচার তদন্ত এগুলোরও কিছু নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এরপর কী হবে? তাঁর তো এসবের মধ্যে যাওয়ারও কথা নয়, তাঁর লেখাপড়া করার কথা। যদি দানবব্যবস্থা অটুট থাকে, তাহলে এই এক ফুলপরী, আরও অনেক ফুলপরী এবং অসংখ্য ছাত্র তাঁদের শিক্ষালাভের নিশ্চয়তা কে দেবে? এ অবস্থা পরিবর্তন করতেই হবে। তার জন্য ফুলপরীর মতো সাহস নিয়ে এগিয়ে আসা শিক্ষার্থী যেমন দরকার, তেমনি দরকার পদলোভী, কমিশনলোভী প্রশাসন-শিক্ষকদের বাইরে প্রকৃত শিক্ষকদের অধিকতর সরব ভূমিকা। এবং অবশ্যই সমাজরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ তৈরি করা।

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

    anu@juniv.edu