দক্ষিণ এশিয়ায় এসে ‘বিরল’ হইচইয়ের মুখে সিআইএ প্রধান

উইলিয়াম বার্নস
ফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) বয়স ৭৬ বছর চলছে এখন। কিন্তু এ রকম ঘটনা এই প্রথম যে, সংস্থাটির প্রধান দক্ষিণ এশিয়ায় এসে হইচইয়ের মুখে পড়েছেন। উইলিয়াম বার্নসের বেলায় তা–ই হলো এবং হচ্ছে। সম্প্রতি প্রথমে নেপালে আসতে তাঁর বিরুদ্ধে আপত্তি দেখা গেল; পরে শ্রীলঙ্কা সফর শেষে সে দেশে রাজনৈতিক শোরগোল ফেললেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও বার্নস উভয়ের জন্য এসব বিব্রতকর হয়েছে। সবাই ভাবছে এ রকম কেন হলো? এসবে মদদ কার? কারও আবার জানার কৌতূহল, এসবের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক ঠান্ডা যুদ্ধের কোনো আলামত আছে কি না?

বার্নসকে নিয়ে নেপালে আপত্তি, শ্রীলঙ্কায় প্রশ্ন

সিআইএতে বার্নসের অগ্রাধিকার চীন। ফলে এটা অস্বাভাবিক নয় নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় বার্নসকে নিয়ে বিতর্ক তৈরির পেছনে বেইজিংয়ের উৎসাহ থাকতে পারে। এ রকম অনুমানের পক্ষে প্রমাণ দাখিল কঠিন। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বার্নসের নেপাল সফরের কথা ছিল। সিআইএর দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম সেখানে আসছিলেন তিনি। কিন্তু মাস শেষে খবর বেরোয়, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দহল এই সফরে আপত্তি দিয়েছেন। তাঁর কথা, এ সময় এ সফর ‘চারদিকে’ ভুল বার্তা দেবে। দহলের আপত্তির পর ১৮ ঘণ্টার ওই সফর আর হয়নি।

নেপালে উইলিয়াম বার্নসের আসার কথা শ্রীলঙ্কা থেকে। সেই দেশের মানুষ অবশ্য এ সফর সম্পর্কে জানত না। তাদের সেটা জানায় স্থানীয় একটি কমিউনিস্ট পার্টি। এই দলের সাধারণ সম্পাদক ডা. উইরিসিংহে প্রথম ৪ মার্চ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে জানান। তিনি সরকারের কাছে এই মর্মে ব্যাখ্যা চান, ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ বিমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে মানুষগুলো কলম্বোয় এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম বার্নস ছিলেন কি না! তিনি এ–ও বলেন, বার্নস ও তাঁর সঙ্গীদের সফর সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ দেওয়া যাচ্ছে না; কারণ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তার রেকর্ড রাখেনি।

উইরিসিংহের বিবৃতি বেশ সাড়া ফেলে। তাতে আরও জ্বালানি জোগান এমপি উদয় গাম্মানপিলে। তিনি এ বিষয়ে অনেক নতুন তথ্য জুড়ে দেন। তাঁর দাবি, বার্নসের সফরে ওয়াশিংটন কলম্বোর কাছে কয়েকটি নিরাপত্তা ইস্যু তুলেছে। গাম্মানপিলে লঙ্কার সংসদে আছেন রাজাপক্ষে দলের নেতৃস্থানীয় একজন হিসেবে। ওপরে উল্লিখিত কমিউনিস্ট পার্টিও সর্বশেষ নির্বাচনে রাজাপক্ষে জোটে ছিল। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে এবং নেপালে দহলদের ‘মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি’ উভয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে গণচীনের বর্তমান শাসকদের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল বা আছে। ফলে উভয় দেশে উইলিয়াম বার্নসকে নিয়ে তাদের চলতি অবস্থানে ভূরাজনৈতিক উপাদান থাকা বিচিত্র নয়।

শ্রীলঙ্কা ও নেপালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়ছে

নেপালে প্রধানমন্ত্রী দহল যখন সিআইএ পরিচালকের সফরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন যুক্তি দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা। সেই নির্বাচন ৯ মার্চ হলো। নেপালে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পদ হলো সবচেয়ে গুরুত্ববহ, প্রেসিডেন্ট নয়। এ রকম একটা কম গুরুত্বের নির্বাচনের সঙ্গে সিআইএ প্রধানের প্রায় তিন সপ্তাহ আগের সফর কীভাবে সম্পর্কিত, দহলের আপত্তিতে কারও কাছে তা স্পষ্ট হয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী দহল এই সফরের প্রকাশ্য কারণ দেখালেও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বা সরকারের কেউই সিআইএ পরিচালককে নিয়ে চলমান বিতর্কে মুখ খুলছে না। ফলে উইলিয়াম বার্নসের সঙ্গে তাদের কী আলাপ হয়েছে বা কী হয়নি, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এমপি গাম্মানপিলের সূত্রে স্থানীয় পত্রপত্রিকার ভাষ্যে বার্নস যৌথ উদ্যোগে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণের একটা সেন্টার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। লঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে একসময় আগ্রহী ছিলেন। এ ছাড়া ওয়াশিংটন শ্রীলঙ্কায় ‘বায়োমেট্রিক ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল সিস্টেম’ চাইছে।

এ রকম উদ্যোগে তাদের যুক্ত থাকার অন্য মানে দাঁড়ায়, দেশটিতে চীন ও ভারতের উদ্যোক্তাদের তথ্যের গোপনীয়তা আর থাকছে না। ফলে ওই দুই দেশ ও তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাজনীতিবিদেরা এ রকম উদ্যোগের বিরোধী। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ‘সোফা’ চুক্তিও (স্টেটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট) করতে চায়। এসব প্রস্তাব এমন এক সময় এল, যখন শ্রীলঙ্কার শাসকদের জন্য আইএমএফের ঋণসহায়তা পাওয়া অতি জরুরি। ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের একটা ঋণের অঙ্ক নিয়ে আলোচনাও চলছে।

নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো টানাপোড়েনে না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র তার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের কৌশলগত কার্যক্রমে এই দেশটিকেও চায়। ওই চাওয়ার অংশ হিসেবে তাদের ইতিমধ্যে ৫০ কোটি ডলারের একটা অনুদান দেওয়া হয়েছে। ওই অনুদান নেওয়ার স্পষ্ট বিরোধিতা করেছিল চীন।

২০২২ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি চীন সরকারের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস নেপালে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ কোটি ডলারের ওই অনুদানকে ‘জবরদস্তিমূলক কূটনীতি’ হিসেবে মন্তব্য করে। ঠিক একই সময় নেপালের সমাজতন্ত্রীরাও অনুদান গ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। প্রতিবাদী ওই বিরোধী শক্তিই এখন কাঠমান্ডুতে ক্ষমতায়। তাদের দ্বারাই উইলিয়াম বার্নসের সফর বাধা পেল। ওই বাধার পর এ–ও দেখা যাচ্ছে, সরকার গঠনকারী মাওবাদী দলের বিরুদ্ধে মানবাধিকার দলনের পুরোনো অভিযোগগুলো বিভিন্ন তরফ থেকে আবার উঠতে শুরু করেছে। ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’কালের সহিংসতা তদন্তের দাবিতে খোদ দহলের বিরুদ্ধেও একটা মামলা হয়েছে। একই সঙ্গে মাত্র দুই মাস আগে গঠিত সরকারের ওপর থেকে এমন একটি দল (ইউএমএল) সমর্থন তুলে নিয়েছে, যাদের সমর্থনের ওপর ভর করে দহল ২৭৫ আসনের সংসদে মাত্র ৩২ আসন সম্বল করে প্রধানমন্ত্রী হন।

পুরোনো ইতিহাস নতুন করে

নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় বার্নসকে নিয়ে চলতি আলাপ-আলোচনা-গুঞ্জনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে বাড়তি তথ্য-উপাত্তসহ শরিক হয়েছে। বার্নস যে বিমানে করে দক্ষিণ এশিয়া সফরে বের হন সেই ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার-৩’ এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদন করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা এ–ও বলতে থামেনি, কলম্বো কিংবা কাঠমান্ডুতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সফরে এ রকম আপত্তি বা হইচই একদম বিরল। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে স্থানীয় যেসব রাজনৈতিক দল প্রতিবাদে নামে ওসব দেশে গৌতম আদানিদের ‘বিনিয়োগ’ নামের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় একই রাজনৈতিক শক্তিসমূহ নীরব থাকে।

এসবের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২৪ ফেব্রুয়ারি সিআইএ পরিচালকের সফর নিয়ে বাড়তি আলোচনার কারণ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় তাঁর সি-১৭ পরিবহন বিমানের সঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক যন্ত্রপাতি ভর্তি আরও দুটি পরিবহন বিমান আসার কথা লিখেছে। এ রকম ‘যন্ত্রপাতি’ নিয়ে চীন-ভারতে আপত্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে নেপালের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কেশব ভট্টরাই বার্নসকে প্রতিরোধে দহলের ভূমিকাকে ‘বড় ধরনের ভুল’ হিসেবেই মন্তব্য করেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে।

নেপালের মতো ‘ভুল’ অবশ্য শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব করছে না। উইলিয়াম বার্নসের সফর নিয়ে তারা চুপচাপ থাকলেও এটা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে প্রচার হয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের আরেকটা দল ১৬ ফেব্রুয়ারি কলম্বো সফর করে গেছে। এই দলের প্রধান ছিলেন জেদিদিয়াহ পি রয়াল। রয়াল আগে ন্যাটোতেও কাজ করেছেন। রয়ালের এই সফরের পর থেকে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক গুজব ত্রিংকোমালিতে যুক্তরাষ্ট্র কিছু সৈন্য রাখার জায়গা চায়। এককালে এই ত্রিংকোমালিতেই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে রয়েল ব্রিটিশ নেভির ঘাঁটি। তারও আগে ডাচদের হাত থেকে প্রথম এ জায়গাটি দখল করেই ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কায় ঢোকে। নতুন বৈশ্বিক ‘ঠান্ডাযুদ্ধে’ নতুন করে আবার সেসব ইতিহাস নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে এখন।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক