বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছর পূরণ হতে যাচ্ছে ৪ নভেম্বর। বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবির কথা জানানো হচ্ছে। সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। তার কতটা জনগণের স্বার্থে আর কতটা শাসকদের স্বার্থে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন আবদুল্লাহ আল ফারুক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। মূল সমস্যা সংবিধান না সংবিধান যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: সংবিধান যেকোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি দলিল এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। সংবিধান একটি চলমান দলিল এবং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের কারণে এটি সংশোধিত হয়। কারণ, এটি কোনো অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। অনেক চড়াই–উতরাই পার হয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চরিত্রে ফিরে এসেছে অনেকটাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে সংবিধান সংস্কার হতে পারে। তবে যেসব বিষয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সংশোধিত, সেগুলো নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই এবং সেসব বিষয়ে সংবিধানের সংস্কারের দাবিও অবান্তর। সংবিধান পরিচালনার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের তিন অংশের—শাসন বা নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সাংবিধানিক বিধিবিধান বলবৎ করা এবং সমুন্নত রাখার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। আইন বিভাগ বা পার্লামেন্ট সংবিধানের সঙ্গে সংগতি রেখে আইন প্রণয়ন করবে এবং বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যা দাতা। এ ছাড়া জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানকে সম্মান করা এবং সাংবিধানিক বিধিবিধান মেনে চলা।
আমাদের সংবিধানের প্রধান দুর্বলতা কোথায়? অনেকেই বলেন, সংবিধান রচনার সময়ই পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। আইনের শিক্ষক হিসেবে আপনি কী বলবেন?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান ছিল সমসাময়িক কালের অন্যান্য দেশের সংবিধানের চেয়ে উন্নত এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং এর রাষ্ট্রীয় পরিচালনার মূলনীতি সমূহ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে সংবিধান প্রণয়নের সময় জনগণের সার্বভৌমত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধান রচিত হয়েছে একটি ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’র মাধ্যমে। এই কমিটি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়োগ এবং গণপরিষদে যথেষ্ট বিতর্ক ও পর্যালোচনার মাধ্যমে, সর্বোপরি একটি গণতান্ত্রিক ও প্রচলিত পদ্ধতির মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধান গৃহীত হয়।
এ পর্যন্ত সংবিধান ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। জনগণের প্রয়োজনে কতবার আর শাসকদের সুবিধার জন্য কতবার? আপনার মতে, সবচেয়ে বিপজ্জনক সংশোধনী কোনটি বা কোনগুলো?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: বাংলাদেশের সংবিধান বহুবার সামরিক শাসকেরা তাঁদের সুবিধার জন্য সংশোধন করেছেন। সংবিধানের মূল চরিত্র ও চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। তবে জনগণের প্রয়োজনেও কয়েকবার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। যেমন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, একাদশ, দ্বাদশ, পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনী। সবচেয়ে বিপজ্জনক সংশোধনীগুলো হচ্ছে পঞ্চম, সপ্তম এবং অষ্টম সংশোধনী, যার মাধ্যমে সংবিধানের ওপরে সামরিক ফরমানকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং সামরিক শাসনামলকে বৈধতা দেওয়া হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম সংশোধনী হচ্ছে পঞ্চম সংশোধনী, যার মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে হত্যা, ‘বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে জারিকৃত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি উঠেছে। আপনি কি মনে করেন এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূল চেতনাই ধ্বংস করা হয়েছে?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্যরা দলত্যাগ বা ফ্লোর ক্রস করতে পারেন না। তবে এই অনুচ্ছেদ পুরো বাতিল করা ঠিক হবে না। কারণ, এর ফলে সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। কারণ, ইতিপূর্বে অর্থ লোভের কারণে পাকিস্তান আমলে দলত্যাগের নজির আছে। ভারতেও দলত্যাগ নিয়ে নানা সমস্যা আছে। এ ছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদটি সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনেকটাই ১৯৭২ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের অনুরূপ রূপ ফেরত পেয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট এক নয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা ঠিক হবে না।
সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সম্মিলিত দায়বদ্ধতা অর্থাৎ মন্ত্রিসভা জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। আমাদের এখানকার বাস্তবতা কী?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পুরো মন্ত্রিসভা জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তবে এটির বাস্তব প্রয়োগ নেই বললেই চলে বাংলাদেশে। তবে মাঝেমধ্যে সংসদের বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদনে মন্ত্রীদের কাজের সমালোচনা করা হয়। সংসদীয় কমিটিগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
বাহাত্তরের সংবিধান বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতিসত্তাকে স্বীকার করেনি। পরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এটি কি তাদের জন্য অপমানকর নয়?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি তাদের জন্য একটি বড় অর্জন। এ ছাড়া সংবিধানের ২৮ এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে সরকারি চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। তবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সংবিধানে সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। সাংবিধানিক বিধান বাস্তবায়ন করার জন্য অনেক সময় আইন করার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের ভূমির মালিকানা রক্ষার জন্য বিশেষ আইনের প্রয়োজন।
আমাদের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন মিলাদ পড়া ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত বলে মনে করেন?
আবদুল্লাহ আল ফারুক: ১৯৭২ সালের সংবিধানটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতির আদলে প্রণীত হয়েছিল বিধায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত এবং প্রতীকী। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়। যেসব দেশে সংসদীয় সমবায় ব্যবস্থা আছে, যেমন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত, ইতালিতে রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা সীমিত। সংবিধানে ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি সব সময়ই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্যনির্বাহ করেন। তবে জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত কোনো বিল আইনে পরিণত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে বিলের বিশেষ কোনো বিধান পুনর্বিবেচনার জন্য বা তা সংশোধনীর জন্য অনুরোধ করতে পারেন তিনি। সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগ অগণতান্ত্রিক বা জনস্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করতে পারে। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারসাম্যের সঙ্গে জবাবদিহিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়বদ্ধতা আছে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহির বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু রাষ্ট্রপতির দায়বদ্ধতা নেই। তবে রাষ্ট্রপতির আইনি ক্ষমতার বাইরে রাষ্ট্রপতির মূল পরিচয় হচ্ছে তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং সংসদে মাধ্যমে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। জাতির ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
আমাদের এখানে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন, যাতে ছোট ছোট দলও শাসনকাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পশ্চিমের অনেক দেশেই আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা আছে।
আবদুল্লাহ আল ফারুক: আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা এখনো কোনো প্রতিষ্ঠিত নীতি নয় এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এটি ইউরোপের গুটিকয় দেশে প্রচলিত। এ পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই আছে। অসুবিধা হচ্ছে সরকার গঠনের সময় অনেক ছোট রাজনৈতিক দলও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে এবং সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। আনুপাতিক ভোটব্যবস্থার কিছু সুবিধা থাকলেও এটি একটি জটিল পদ্ধতি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আল ফারুক: আপনাকেও ধন্যবাদ।