এবার যখন বাশার আল-আসাদের পতন শুরু হলো, রাশিয়া তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ১০ দিনেরও কম সময়ে দেশজুড়ে অভিযান চালিয়ে আলেপ্পো, হামা ও হোমস দখল করে নিয়েছেন এবং রোববার রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করেছেন। পুরো সময়টাতেই রাশিয়া মূলত দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে। বাশার আল-আসাদ এখন ক্ষমতাচ্যুত। তাঁর পতন উদ্যাপন করছে সিরিয়ার জনতা। আর আসাদ এখন রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
আসাদ সরকারের পতন রাশিয়ার জন্য এক বিশাল ক্ষতি। রাশিয়া গত কয়েক দশকের সামরিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছিল। সে প্রচেষ্টা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় কিছু স্বার্থ ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু তিনি যে এক বড় পরাজয়ের শিকার হলেন, সে সত্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
বাশারের বাবা, হাফিজ আল-আসাদ, সিরিয়াকে সোভিয়েত প্রভাববলয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৭০-এর দশকে। রাশিয়া ও আসাদ পরিবারের সম্পর্ক তখন থেকেই ঘনিষ্ঠ। তরুণ আসাদ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে দমন করতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেটা ছিল ২০১২ সাল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে আসাদের পদত্যাগ করার প্রস্তাব এসেছিল। রাশিয়া সেই প্রস্তাবে ভেটো দেয়।
তার এক বছর আগে লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিমান হামলার অনুমতি দিতে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। পুতিন একে ‘মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের ডাক’ বলে নিন্দা করেছিলেন। গাদ্দাফির মৃত্যুর পর পুতিন খুব ক্ষুব্ধ হন। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে বাশার আল-আসাদের যেন একই পরিণতি না হয়।
এর পর থেকে পুতিন আসাদকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিয়েছেন। ২০১৫ সাল নাগাদ আসাদের বাহিনী সিরিয়ার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছিল। তখন রাশিয়া সামরিক অভিযান চালিয়ে তাঁকে রক্ষা করে। রাশিয়া ২০১৭ সালে সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে। পরে সেই অঞ্চলগুলো আসাদের বাহিনী দখল করে।
ধীরে ধীরে রাশিয়া তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনে। ছোটখাটো সংঘাত মোকাবিলায় যতটুকু দরকার, ততটাই রাখা হয়। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পরও রাশিয়া সিরিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেনি। লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র এবং সাহেল অঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক কার্যক্রমের জন্য সিরিয়ার হিমেইমিম বিমানঘাঁটি ও তার্তুস নৌঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সিরিয়ার বর্তমান বিজয়ীদের রাশিয়া আগে বলত ‘সন্ত্রাসী’ আর এখন বলছে ‘সশস্ত্র বিরোধী’। তাদের কূটনৈতিক ভাষার এ পরিবর্তন ইঙ্গিত দেয় যে আলোচনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক সহায়তার পাশাপাশি ধৈর্য নিয়ে রাশিয়া রাজনৈতিক সমর্থন জুগিয়ে গেছে সিরিয়ার আসাদের পক্ষে। বহুবার শান্তি আলোচনায় পুতিন ও আসাদ জোটবদ্ধ থেকেছেন। ২০১৩ সালে পুতিন আসাদের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিমান হামলা ঠেকান। পুতিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এক বছরের মধ্যে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করার। তবে পরবর্তী সময়ে স্যারিন গ্যাস হামলায় ৮০ জনের বেশি সিরিয়ান বেসামরিক নাগরিক মারা যান। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র আসাদের বাহিনীকেই দায়ী করে।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া সোচি শহরে সিরিয়ান কংগ্রেসের আয়োজন করেছিল। সেখানে আসাদপন্থী প্রতিনিধিরাই প্রাধান্য পেয়েছিলেন। এখানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকে কাটছাঁট করে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধ যখন মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে আসে, তখন মস্কোর কূটনীতিকেরা পুনর্গঠন, উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন ও আসাদের পুনর্বাসনের প্রচারণা শুরু করেন।
তবে পুরো সময়ে আসাদের শাসন সামান্যতম ছাড় বা বিবেচনা করতে রাজি হয়নি। পুতিন নিজেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
তবে গত মাসে যখন সংঘাত হঠাৎ আবার তীব্র হয়ে ওঠে, রাশিয়া শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। আসাদের নিজের বাহিনী বিদ্রোহীদের পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। আর ইরানও তখন আসাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। রাশিয়া বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত ইদলিবে বোমা হামলা বাড়ায়। কিন্তু তারা নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়নি। রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা ইউক্রেনে কেন্দ্রীভূত। পুতিন বুঝতে পারেন যে আসাদকে ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। এখন সিরিয়ায় তাঁকে রুশ সামরিক ঘাঁটি রক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তবু আসাদের পতন পুতিনের জন্য একটি পরাজয়। মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি আরব দেশগুলো আসাদের প্রতি রাশিয়ার সমর্থনকে ঘৃণা করত। তবু পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের ছুড়ে দেওয়া অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর মিত্রের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থানের জন্য কিছু সমীহ আদায় করেছিলেন। সেই সম্মান এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। পুতিন আসাদকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হয়তো বোঝালেন যে তিনি তাঁর মিত্রদের একেবারে পরিত্যাগ করেন না।
রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে পুরো পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই বলে ব্যাখ্যা করতে পারবে। মিত্র আর্মেনিয়াকে ছেড়ে আসা আঞ্চলিক বাস্তবতা পরিবর্তনের অজুহাতে ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু সিরিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। আসাদকে পরিত্যাগ করা পুতিনের ক্ষমতার নতুন সীমার স্পষ্ট প্রমাণ।
সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর ইরান দুর্বল হয়েছে। রাশিয়া এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও তুরস্কের কাছে প্রভাব হারাতে পারে। ইসরায়েল এখন সিরিয়ায় আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ার ক্ষতি আরও বড় হতে পারে। সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে তুরস্ক এখন রাশিয়ার ওপর আরও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারবে।
হিমেইমিম ও তার্তুস ঘাঁটি এখন রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে রাশিয়া এগুলো রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তারা সিরিয়ার বর্তমান বিজয়ীদের আগে বলত ‘সন্ত্রাসী’ আর এখন বলছে ‘সশস্ত্র বিরোধী’। তাদের কূটনৈতিক ভাষার এ পরিবর্তন ইঙ্গিত দেয় যে আলোচনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
এ আলোচনায় রাশিয়া কতটা সফল হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব আর আগের মতো হবে না।
হানা নটে ক্যালিফোর্নিয়ার জেমস মার্টিন সেন্টার ফর নন–প্রোলিফারেশন স্টাডিজের ইউরেশিয়া নন–প্রোলিফারেশন প্রোগ্রামের পরিচালক
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন