বাতাসে উড়ছে দুর্নীতির দূষণকণা

‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা, কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে’—জনপ্রিয় এ গান ঢাকাবাসী গাইতে পারেন এভাবে, ‘বাতাসে বহিছে বিষ, নাকেতে লাগিল সিসা, মরণ ডাকিল পিছে, বসন্ত আসে কাছে।’ বায়ুদূষণে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে ঢাকা তার শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রাখছে।

ঢাকার এবং আশপাশের শহরে বায়ুদূষণের হাল ‘বিপজ্জনক’। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘ঢাকায় নিশ্বাস নিলেও বিপদ’। হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন, ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে হাইকোর্ট এ বিষয়ে ৯ দফা করণীয়র নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত নেমেছেন। নির্মাতা-ঠিকাদারদের জরিমানার খবরও পড়লাম। কিন্তু ঢাকার বাতাসের দূষণের মাত্রা কমছে না!

ঢাকার এবং বাংলাদেশের বহু জায়গার বায়ুদূষণের কারণগুলো বহুল আলোচিত। এক নম্বর কারণ নির্মাণকাজ। রাস্তা বানানো হচ্ছে বা বড় করা হচ্ছে, বড় বড় ভবন তৈরি হচ্ছে, চলেছে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি। এসব জায়গায় ধুলায় চোখ মেলাই মুশকিল। ঢাকার যেকোনো গাছের পাতার দিকে তাকান—ধুলোর পুরু প্রলেপ। দ্বিতীয় কারণ কলকারখানার ধোঁয়া। তৃতীয় কারণ অতিরিক্ত গাড়ি, পুরোনো গাড়ি, ভেজালযুক্ত জ্বালানি তেল। আমাদের জ্বালানি তেল সিসামুক্ত, সালফারমুক্ত কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ে মনিটরিং নেই।

২০১১ সালের মে মাসে ‘জার্নাল অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ’-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে শাকিল আহমেদ ইবনে মাহমুদ শিরোনাম করেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বায়ুদূষণে প্রতিবছর ১৫ হাজার জন মারা যান: প্রশাসনের ভূমিকা এবং সরকারের সততা’। আসলেই সবকিছুর সঙ্গেই যুক্ত আছে সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্তির প্রশ্ন।

বাংলাদেশের বাতাসে আসলে উড়ছে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষকণা। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ বিদেশে টাকা পাচারে শীর্ষস্থান অধিকার করার গৌরব ধরে রেখেছে। ব্যাংক থেকে নাম-না-জানা ঠিকানাবিহীন কোম্পানি হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে এবং লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কানাডা, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড—দেশে দেশে বাড়ি কেনায় বাংলাদেশিদের জয়জয়কার।

আমরা জানি, রাস্তায় যন্ত্রযান চালাতে হলে সেসবের ফিটনেস সনদ আনতে হয়। এখন ঢাকায় অজস্র ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে কোন ধরনের সনদে? একটা কারখানা চালাতে হলে, একটা ভবন বানাতে হলেও অনেক ছাড়পত্র লাগে। এখন, ওই কারখানা বা ভবন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটা দেখার পর সনদ দেওয়া হয়, নাকি এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র? কিছু বৈধ ফিস, কিছু উপরি দিয়ে এই সনদগুলো আনিয়ে বা বানিয়ে নেওয়া হয়?

বাংলাদেশের বাতাসে আসলে উড়ছে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষকণা। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ বিদেশে টাকা পাচারে শীর্ষস্থান অধিকার করার গৌরব ধরে রেখেছে। ব্যাংক থেকে নাম-না-জানা ঠিকানাবিহীন কোম্পানি হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে এবং লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কানাডা, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড—দেশে দেশে বাড়ি কেনায় বাংলাদেশিদের জয়জয়কার। পানামার মতো দেশগুলোতেও চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ডলার। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

দুর্নীতি বন্ধ না হলে গোড়া কেটে গাছের ডগায় পানি ঢালার মতো অবস্থা তো হবেই। একটা কাল্পনিক উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আফ্রিকার একটা শহরের এক মোড়ে যানজট দূর করার জন্য প্রকল্প বানানো হলো। এটার খরচ ধরা হলো এক হাজার কোটি টাকা। ঠিকাদার এই কাজ পাওয়ার জন্য জায়গায়-বেজায়গায় খরচ করল ২০০ কোটি টাকা। এখন এই ২০০ কোটি টাকা যাঁরা পেলেন, সেই টাকা তাঁরা রাখবেন কোথায়? সহজ উপায় হলো বিদেশে পাচার করে দেওয়া। তারপর ঠিকাদার রাস্তা খুঁড়তে শুরু করলেন। সেটার দেখভালের দায়িত্ব যাঁদের, পরিবেশের ক্ষতি যাতে না হয়, তা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাও পেলেন টাকার ভাগ। বাতাস দূষিত হচ্ছে। ওই এলাকায় যানজট আরও বেড়ে গিয়ে সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে। কিন্তু কাজ আর শেষ হলো না। একদিন দেখা গেল, ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন। আবার খোঁজো নতুন ঠিকাদার। আবার টাকা বরাদ্দ। দুই বছরের কাজ বিশ বছর ধরে করার পর দেখা গেল, নকশা ছিল ভুল। এটা আমেরিকার ডিজাইন, রাস্তার ডান পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যে দেশে। এই দেশে চলে বাঁ দিক দিয়ে। এই ফ্লাইওভার আবার ভাঙতে হবে। আবার তহবিল বরাদ্দ করো। আবার দরপত্র আহ্বান। আবার দুর্নীতি। এই রকম একটা দেশে পানি দূষিত হবে, মাটি দূষিত হবে, বাতাস দূষিত হবে—এ-ই তো স্বাভাবিক।

আচ্ছা, বাদ দিন আফ্রিকার দেশের কথা। বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো অবৈধ। কিন্তু আপনি ঢাকার আশপাশে এবং ঢাকার বাইরে যান, সবখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাই। এটা যদি অবৈধই হয়, আমদানি হয় কীভাবে, দেশেই-বা কীভাবে নির্মাণ করা হয়? কে ছাড়পত্র দেয়? পরিবেশ অধিদপ্তর এগুলোকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না। কারণ, ব্যাটারিগুলো ক্ষতিকর বর্জ্য হয়ে পরিবেশ দূষণ করে। আমার মত হলো, বিদ্যুচ্চালিত অটোরিকশার একটা মান নির্ধারণ করে দিয়ে সেই মান অনুযায়ী এগুলোকে বৈধতা দেওয়া হোক।

আমাদের বৈদ্যুতিক যানকে উৎসাহিত করতে হবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আমাকে বলেছেন, ‘মধ্যরাতের পর দেশে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে যায়। এই সময় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ দেওয়া হলে সাশ্রয় হবে।’ দেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি এসে গেলে জ্বালানি তেলের আমদানি কমবে। বাতাস কম দূষিত হবে। একইভাবে ঢাকার এবং দেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে ট্রেনকেন্দ্রিক করা দরকার। আর ট্রেনগুলো যদি বিদ্যুচ্চালিত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের মেট্রো পুরো মাত্রায় চালু হয়ে গেলে ঢাকার বায়ুদূষণ অনেকটাই কমবে। সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে নৌযোগাযোগের ওপরে। তাহলে সড়কের ওপর চাপ কমবে। আজ যদি ঢাকার খাল ও নদীগুলো দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারতো, তাহলে এ শহরের এত অধঃপতন হতো কি? এই নদী ও খালগুলো কেন দখল হয়, কারা করে, তা নিশ্চয়ই আমাদের কারও অজানা নয়।  
ঢাকার বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। গায়ে শুধু ঘষা লাগার দাগ। একেকটা যখন চলে, মনে হয়, একটা ইটের ভাটা চলছে, এমনই তার ধূম্র-উদ্‌গিরণ। ঢাকা শহরে সাইকেল চলার লেন দরকার। কোথায় পাব সেই জায়গা?

আমাদের নির্মাণকাজগুলোকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি মানতে বাধ্য করা দরকার। সেটার জন্য চাই মনিটরিং। অর্থাৎ সুশাসন। অর্থাৎ আইনের শাসন। তারও আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমরা চাই কি না যে, আমাদের জনপদগুলোর পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকুক।

হাইকোর্টের নির্দেশনার ৯ দফা করনীয়ের মধ্যে আছে: ঢাকা শহরে মাটি/বালু/বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালু/সিমেন্ট/পাথর/নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন রাস্তায় পানি ছিটানো; রাস্তা/কালভার্ট/কার্পেটিং/খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; মার্কেট/দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করা।

হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী কাজ হলে আজ আপনার–আমার শিশুসন্তানকে শ্বাস নেওয়ার নাম করে বুকে বিষ টেনে নিতে হতো না। কিন্তু হাইকোর্টের এই আদেশগুলো মান্য করতেও তো লাগবে দক্ষ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত একটা শাসনযন্ত্র। সেটাই-বা পাব কোথায়, কখন এবং কীভাবে?

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক