মতামত

ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান কি সত্যিই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?

গাজা যুদ্ধে ইরান যদি বড় মাত্রার সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দুই শত্রুদেশের মধ্যে হিংসার নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।
ছবি: রয়টার্স

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল যদি নির্বিচার বোমাবর্ষণ বন্ধ না করে তাহলে ইসরায়েলকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ইরান। তেহরানের এই সতর্কবার্তাকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, ইরান তার মিত্রদের ও প্রক্সি যোদ্ধাদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে প্রবেশ করতে চলেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এরই মধ্যে লেবানন সীমান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে ছোট মাত্রার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সিরিয়ার আসাদ সরকারও ইরানের খুব ঘনিষ্ঠ মিত্র।

ইরানের দিক থেকে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বাড়ার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এখন এই বিবেচনা করছে যে তেহরান কখন ও কীভাবে এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ইরান ইস্যুতে ইসরায়েলের অবস্থান আপসহীন। অতীতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর সার্জিক্যাল হামলা করার জন্য ওকালতি করেছিল তেল আবিব। ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যার সঙ্গে তারা জড়িত ছিল।

গাজা যুদ্ধে ইরান যদি বড় মাত্রার সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দুই শত্রুদেশের মধ্যে হিংসার নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। ইসরায়েলের প্রতি ইরান কঠোর সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও গাজা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে যথেষ্ট অনিচ্ছুক তেহরান। কেননা, এতে ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেবে।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানি শাসকেরা তাঁদের মতাদর্শিক বাগাড়ম্বর এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে কঠিন ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরান আগুন নিয়েই খেলছে। কেননা, ভারসাম্য বজায় রাখার যে পথ তারা অনুসরণ করে আসছে, সেটি খুব সহজেই যুদ্ধের কুয়াশায় ঢেকে যেতে পারে।

এখন পর্যন্ত ইরানের শাসকেরা তাঁদের বিপদরেখা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সজাগ। তাঁরা জানেন যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে সেটা তাঁদের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি তৈরি করবে। এ কারণে ইরান অব্যাহতভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলে বলেও যুদ্ধে জড়াবে না। বরং তাদের মিত্র কিংবা প্রক্সি শক্তি দিয়ে ছোট পরিসরে সংঘাত অব্যাহত রাখবে। এতে তাদের মতাদর্শিক অবস্থান রক্ষা পাবে, অস্তিত্বও বিপন্ন হবে না।

ইসরায়েল ইস্যুতে তেহরানের সরকারি অবস্থান চূড়ান্ত কট্টর। তেহরান ইসরায়েলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তারা মনে করে ইসরায়েল একটি জায়নবাদী অস্তিত্ব।

জুন মাসে, তেহরান তাদের সর্বশেষ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। তাদের সেই ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ব্যানারে ফারসি, হিব্রু ও আরবি ভাষায় লেখা ছিল, ‘৪০০ সেকেন্ডে পৌঁছে যাবে তেল আবিব’।

সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির নেতৃত্বে ইরান ইসরায়েলবিরোধী ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কট্টর রাজনৈতিক অবস্থান লালন করে। এ উপদলটি বিচার বিভাগ, পার্লামেন্ট ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডসকেও নিয়ন্ত্রণ করে।

যাহোক, ইরানি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ যে ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ লেগে গেলে, এমনকি তেহরানের কোনো একটি প্রক্সি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত বেধে গেলেও, তেহরানকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। এতে ইরানের স্থাপনার ওপর ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক হামলা চালাবে। তাতে রাজনৈতিক অভিঘাত সৃষ্টি হবে এবং ইরান সরকার তাদের জনগণের কাছে আরও অজনপ্রিয় হয়ে পড়বে।

শাসকদের মতাদর্শিক বাগাড়ম্বর সম্পর্কে ইরানি জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে। এর কারণ হলো, তাঁরা দেখছেন তাঁদের শাসকেরা দুর্নীতি ঢাকতে কীভাবে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছেন। শাসকদের কারণে তাঁরা অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছেন। নাগরিকদের চাহিদা পূরণে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।

গত বছর মাসা আমিনির হত্যার পর ইরানজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে ইরানের শাসকগোষ্ঠী কতটা অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। এ বাস্তবতায়, ইসরায়েলের সঙ্গে একটা সংঘাত তাদের জন্য অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

ইরানের শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের লাল রেখা অতিক্রম করে খোলাখুলি সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে সতর্ক। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ইরানি কর্তৃপক্ষ কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ ছিল তুলনামূলকভাবে নমনীয়। ইরাকে দুটি বিমানঘাঁটিতে (মার্কিন সেনাদের ঘাঁটি) আগে থেকেই সতর্ক করে তারা হামলা করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইরানও একই পথ অনুসরণ করে। সিরিয়ায় ইরানের মিত্রদের ওপর লক্ষ্য করে ইসরায়েল প্রায়ই হামলা করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে, ২০১৮ সালে সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুর ওপর ৭০ বার বিমান হামলা করেছিল ইসরায়েল। এই হামলার পাল্টায় ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা করা থেকে বিরত থাকে।

২০২০ সালেও সিরিয়ায় ইরানি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছিল ইসরায়েল। এ বছরও সিরিয়ায় ইরানি বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা করেছিল ইসরায়েল। কিন্তু এসব হামলায় ইরানের প্রতিক্রিয়া ছিল নমনীয়।

এখন পর্যন্ত ইরানের শাসকেরা তাঁদের বিপদরেখা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সজাগ। তাঁরা জানেন যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে সেটা তাঁদের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি তৈরি করবে। এ কারণে ইরান অব্যাহতভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলে বলেও যুদ্ধে জড়াবে না। বরং তাদের মিত্র কিংবা প্রক্সি শক্তি দিয়ে ছোট পরিসরে সংঘাত অব্যাহত রাখবে। এতে তাদের মতাদর্শিক অবস্থান রক্ষা পাবে, অস্তিত্বও বিপন্ন হবে না।

  • শাহরাম আকবারজাদেহ মধ্যপ্রাচ্য স্টাডিজ ফোরামের আহ্বায়ক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত