মতামত

দূরপাল্লার বাসের যাত্রীদের শৌচাগার-বিড়ম্বনা আর কত দিন

বিকেল সাড়ে চারটার বাস ছাড়ল আধ ঘণ্টা দেরি করে পাঁচটায়। শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাসটি রাজশাহী শহর থেকে ছেড়ে এসেছে। নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও সাভার হয়ে ঢুকবে ঢাকায়। আমি উঠলাম নাটোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে, ঢাকায় যাব।

৫টায় ছাড়ার পর ৬টা ১২ মিনিটে যাত্রাবিরতি দিল সিরাজগঞ্জের একটি রেস্তোরাঁর সামনে এসে, ২০ মিনিটের জন্য। যাত্রীরা প্রয়োজন অনুযায়ী নাশতাপানি খেলেন, ওয়াশরুম ব্যবহার করলেন।

যাত্রাবিরতি শেষে ঢাকার উদ্দেশে বাস আবার ছাড়ল ৬টা ৩৫ মিনিটে। যতটুকু পথের দূরত্ব, তাতে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যেই বাসটির গাবতলীতে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু সেই বাস ধুঁকতে ধুঁকতে ঢাকায় এল রাত ১১টায়। সাভার থেকে গাবতলী, এটুকু পার হতেই অনেক সময় লাগল। এ পথের যাঁরা যাত্রী, এ তাঁদের নিত্য অভিজ্ঞতা।

যানজটের কষ্ট বা এ থেকে পরিত্রাণের উপায়, আজকের লেখার বিষয় নয়। আজকের ‘সাবজেক্ট’ একটু ভিন্ন। সাভারের কাছাকাছি এসেই আমাদের বাসের কিছু যাত্রী উসখুস করছিলেন। বিশেষ করে ৩০ বছর পর রাজশাহী যাওয়া সেই ভদ্রলোকটি। বয়স্ক নারী যাত্রী ছিলেন কয়েকজন।

তাঁরাও অস্বস্তিতে ছিলেন। তাঁদের সবারই ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মহাসড়কের দুই পাশে তেমন কোনো গণশৌচাগার নেই, আবার বাস থামানোরও সুযোগ সীমিত। তাই কষ্ট করে, নিজের শরীরের বড় ক্ষতি করে অসুখী হয়ে বসে রইলেন তাঁরা। আর অপেক্ষা করছিলেন ঢাকায় বাস কাউন্টারে পৌঁছানোর।

২.

বিষয়টি হলো, মহাসড়কে একটা নির্দিষ্ট সময় পর দূরপাল্লার পরিবহনগুলো যাত্রাবিরতি দিলেও সে সময় সব যাত্রীর ওয়াশরুম ব্যবহার করার প্রয়োজন না-ও পড়তে পারে। বাস ছাড়ার পর সে প্রয়োজন অনুভূত হতে পারে। একেবারে বিশেষ পরিস্থিতিতে হয়তো চালক বাস থামাতে রাজি হবেন।

কিন্তু একাধিক যাত্রী যদি হাত তুলে বারবার বাস থামানোর অনুরোধ জানান, সেটা আবার বাস্তবসম্মত নয়। সবচেয়ে সমস্যা হয় গাড়ি যানজটে পড়লে। তখন আর কোনো হিসাব কাজ করে না। তখন যাত্রীরা ওয়াশরুম ব্যবহার করতে না পেরে সবচেয়ে কষ্টকর সময় পার করেন।

তখন আশপাশের দৃশ্য, বৃক্ষরাজি, আকাশ-মেঘ যতই সুন্দর হোক না কেন, কোনো কিছুই ভালো লাগে না। দিনের বেলায় তা-ও পুরুষ লোকেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যান, যদিও সেটা শোভন দেখায় না। এ সময় সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন আমাদের মা-বোনেরা। কেউ কেউ মহাসড়কের পাশে কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়েন। বেশির ভাগই বসে থাকেন ইউরিন চেপে রেখে। এতে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় পড়েন। হতে পারে মূত্রনালিতে সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই)।

আমাদের দরকার যৌক্তিক ও টেকসই সমাধান। মহাসড়কের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গণশৌচাগার স্থাপন করতে হবে। তা হতে হবে উন্নতমানের, যেমনটা ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বানিয়েছিলেন। সেখানে দিকনির্দেশক চিহ্ন থাকবে, যাতে সহজেই বাসচালকেরা তা দেখতে পান।

৩.

দেশের মহাসড়কগুলো এখন মোটের ওপর ভালো। তুলনামূলক কম সময়ে বেশি দূরত্বের গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ঢাকা থেকে আমার নিজ জেলা বাগেরহাটে পৌঁছানো যায় আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার মধ্যে, পদ্মা সেতু যুগের আগে যেখানে লাগত ছয় থেকে আট ঘণ্টা। কখনো কখনো এর চেয়েও বেশি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এখন বাসে পাঁচ ঘণ্টায় যাওয়া যাচ্ছে, মাঝে কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি তো থাকছেই।

সেখানে চা-রুটি খেয়ে চাঙা হয়ে বন্দরনগরীর দিকে যাত্রা করা, সব মিলে ভ্রমণ ভালোই হয়। রংপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের সড়কগুলো অবশ্য ততটা স্বাচ্ছন্দ্যের নয়। যদিও ট্রেন সেখানে ভালো। একটা শ্রেণি আছে, ট্রেনে ভ্রমণই বেশি করেন।

আমাদের দুর্বল মহাসড়কগুলোর উন্নতি দরকার। কাজ চলছে, প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মহাসড়কের পাশে উন্নতমানের গণশৌচাগার স্থাপন অতি প্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ কম। মহাসড়কের দুই পাশে জ্বালানি তেলের পাম্পগুলোতে কিছু শৌচাগার আছে বটে, তবে তা একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগী থাকে।

বাঙালির সব শিক্ষাদীক্ষা, রুচি, সংস্কৃতির প্রমাণ মেলে এসব শৌচাগারে ঢুকলে। আবার যে শৌচাগারটি তুলনামূলক ‘উন্নতমানের’, সেটা থাকে তালা দেওয়া। পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ভিআইপি বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের জন্য সেটি সংরক্ষিত, সাধারণের জন্য নয়।

জ্বালানি তেলের পাম্পগুলোর শৌচাগার ভালো রাখার দায়িত্ব এর কর্তৃপক্ষের। প্রতি মাসে একবার-দুবার এসব পাম্পে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যেতে পারে।

৪.

দূরপাল্লার বাসের পেছনের অংশ ছোট্ট ওয়াশরুম স্থাপন করা নিয়ে একটি আলোচনা আছে, সেখানে থাকতে পারে একটি ছোট্ট বেসিন ও জল বিয়োগের ব্যবস্থা। একসময় কিছু বাসে এমন ব্যবস্থা ছিল। ভারতেও কিছু দূরপাল্লার বাসে তা আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা বাস্তবসম্মত নয়।

বুধবার দুপুরে কথা বলেছিলাম ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে। তিনিও জানালেন, বাসে ছোট্ট ওয়াশরুম স্থাপন করলে বাসের আসনসংখ্যা আরও কমে যাবে। এতে সিটভাড়া বেড়ে যাবে। যাত্রীদের ওপর চাপ বাড়বে। আর এমন ব্যবস্থা করলে দুর্গন্ধও হতে পারে। খন্দকার এনায়েত উল্লাহর কথা সঠিক বলে মনে করি।

আমাদের দরকার যৌক্তিক ও টেকসই সমাধান। ওপরে যে কথা সামান্য লিখেছি, তাতে আবার ফিরে আসি। মহাসড়কের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গণশৌচাগার স্থাপন করতে হবে। তা হতে হবে উন্নতমানের, যেমনটা ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বানিয়েছিলেন। সেখানে দিকনির্দেশক চিহ্ন থাকবে, যাতে সহজেই বাসচালকেরা তা দেখতে পান।

আমার মনে হয়, এখানে বেসরকারি উদ্যোগ আসতে পারে। ইতিপূর্বে সরকারি নির্মিত গণশৌচাগার দখলের খবর সংবাদপত্রে পড়েছি। বেসরকারি উদ্যোগে এমন গণশৌচাগার নির্মিত হলে যাত্রীরা অর্থের বিনিময়ে তা ব্যবহার করবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। বাসমালিকেরাও এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।

পাশাপাশি যদি সেখানে চা, কফি পানের ব্যবস্থা থাকে, সেটা আরও ভালো হয়।
এ লেখা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নূর এ আলম সিদ্দিকীর কথা, যিনি গত বছর ঈদের সময় যানজটে পড়া সাধারণ যাত্রীদের কথা ভেবে মহাসড়কের পাশে বেশ কিছু অস্থায়ী গণশৌচাগার নির্মাণ করেছিলেন।

ধন্যবাদ জানাই তাঁকে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন স্থায়ী ব্যবস্থা। দূরপাল্লার বাসে আনন্দ নিয়ে ভ্রমণ যাত্রীদের অধিকার। কারণ, এর জন্য তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। বাসমালিকদের ভাবনার মধ্যে যাত্রীদের সামগ্রিক স্বস্তির বিষয়টি আসতে হবে, যা এখন নেই বলতেই হচ্ছে।

যাত্রীদের কল্যাণে যেসব সংগঠন কাজ করছেন, তারাও মহাসড়কের পাশে বেশি সংখ্যায় গণশৌচাগার নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সরব হতে পারেন।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    alim.zaman@prothomalo.com