১৯৭০ সালের দিকে এ দেশের রাজনীতিতে নকশালবাড়ী আন্দোলনের একটা ঢেউ উঠেছিল। তখন চারদিকে বইছে নির্বাচনের হাওয়া। তো একদল লোক স্লোগান দিলেন, নির্বাচন না বর্জন, বর্জন বর্জন। নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের মুক্তি নেই। একদলকে হটিয়ে আরেক দল আসে। ভিন্ন নাম, একই কাজ।
সুতরাং নির্বাচনের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, ‘বন্দুকের নলই সব ক্ষমতার উৎস।’ সুতরাং সশস্ত্র বিপ্লব করতে হবে। চেয়ারম্যান মাও এর পর যে বাক্য বলেছিলেন, সেটি আর কেউ আওড়ায় না, ‘বন্দুক কার হাতে আছে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।’
এখন অবশ্য এই স্লোগান আর কেউ দেন না। যাঁরা দিতেন, তাঁরা কেউ কেউ এখন জাতীয় সংসদ ভবন আলোকিত করে আছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক বলে গলার রগ ফুলিয়ে কণ্ঠ সপ্তমে চড়িয়ে যিনি বুলন্দ আওয়াজ তুলতেন, আজ তিনি ইতিহাসের জাবর কাটেন। তাঁর সন্তানেরা মার্কিন দেশের স্কুল-কলেজে পড়ে কিংবা করে খায়।
তিনিও অভিবাসী বা মাঝেমধ্যে বেড়াতে যান। দেশে ফিরে আক্ষেপ করে বলেন, এখানে অনেক ধুলাবালু, শ্বাস নেওয়া যায় না। দেশটা উচ্ছন্নে গেছে। তাঁদের একদা শত্রু বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়ারাও তাঁদের সন্তানদের পাচার করে দিচ্ছেন বিদেশে। কেননা এ দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সন্তানেরা বাইরে। তাঁরা রাজনীতি করেন এখানে। তাঁদের হয়ে জিন্দাবাদ দেন অন্যের সন্তানেরা। তারপরও দেশটা এখনো একটা কামধেনু। অনেক দোহন করা যায়।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোয় তিন কলামের একটা সংবাদ শিরোনামে চোখ আটকে গেল—‘সব সুবিধা খেলাপিদের জন্য’। ওপরে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া একটি গ্রাফ—‘যেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে’ (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০২২)। প্রতিবেদক শওকত হোসেন গ্রাফে পাঁচ বছরওয়ারি হিসাব দেখিয়েছেন। এতে ধারণা পাওয়া যায়, কোন সময় কারা দেশ চালিয়েছে। যেমন ১৯৯০-৯৫ সালের অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তখন খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ১৯৯৫-২০০০ সালের বেশির ভাগ সময় দেশ ছিল আওয়ামী লীগের হাতে।
ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। তিনি একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকেরও গভর্নর ছিলেন। কথা বলার জন্য আমি গিয়ে হাজির হলাম যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে তাঁর বাসায়। কথায় কথায় তিনি ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য দেন ও মন্তব্য করেন। তাঁকে উদ্ধৃত করছি: ‘দুর্নীতি ছিল একটা বড় সমস্যা। এ জন্য অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে ব্যাংক খাতের সংস্কার ছিল জরুরি। সরকার ওই সময় একটি ব্যাংকে তিন শ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছিল। তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি বরখাস্ত হয়েছিলেন। সরকার নিয়ম চালু করেছিল, কোনো পরিবার থেকে একটি ব্যাংকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না।’
তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে দ্বিগুণের কিছু বেশি। পরের পাঁচ বছরের (২০০০-২০০৫) আশি ভাগ সময় বিএনপির কবজায় ছিল দেশ। তখন খেলাপি ঋণ বেশ খানিকটা কমেছিল। ২০০৫-২০০৮ মেয়াদে বিএনপি আর এক-এগারোর সরকার ছিল দেশে। ওই সময় খেলাপি ঋণ বেড়েছে সামান্য। ২০০৮ সাল থেকে দেশে আওয়ামী লীগের সরকার। গত ১৪ বছরে দেশে অনেক বড় বড় স্থাপনা হয়েছে। আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে। আমরা বিশ্বে রোল মডেল হয়েছি। খেলাপি ঋণ বেড়েছে ছয় গুণ, একেবারে রকেটগতিতে।
প্রথম আলোর এই সংবাদের পাশে আছে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের বিশেষজ্ঞ মতামত: ‘খেলাপি ঋণের বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ কখনোই ফেরত আসবে না। পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে বাড়ি কিনেছেন পাচারকারীরা। সম্পত্তি কিনেছেন। পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে অনেকেই এখন ওই সব দেশে আসা-যাওয়া করছেন। একটা পর্যায়ে তাঁরাও চলে যাবেন। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট, তার নেপথ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার বেড়ে যাওয়া।’
সরকার বলে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে উন্নয়ন হয়। কিছু কিছু লোকের এটা সহ্য হচ্ছে না। তাঁরা শুধু সমালোচনা করেন। সুতরাং তাঁরা উন্নয়ন চান না। কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনে যে একটা ভয়ংকর অন্ধকার দিক আছে, সেটি এখন টের পাচ্ছি। প্রায় প্রতিবছর ব্যাংকঋণ রিশিডিউল করা হয়। তখন নানান ছলছুতায় খেলাপিকে খেলাপির খাতা থেকে কেটে ‘বকেয়া’ হিসেবে দেখানোর কসরত চলে। এই খেলা চলছে অনেক বছর ধরে। এখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে, একজন খেলাপি হওয়ার পরও তিনি আবার কী করে ঋণ পান? কোন বিবেচনায় ব্যাংক তাঁকে ঋণ দেয়?
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এনজিওদের দেওয়া ঋণের উচ্চ হারে সুদ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা অনৈতিক। খুবই ভালো কথা। এনজিওর ঋণ নেন গরিব মানুষ। সুদের পরিমাণ বেশি হলে বছর শেষে দেনা শোধ করার পর নতুন বিনিয়োগের জন্য তাঁর হাতে সঞ্চয় থাকে না। তাঁকে আবার ঋণ নিতে হয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। এ এক দুষ্টচক্র। এটাকে বলা যায় ‘রিসাইক্লিং অব ডেট’। গভর্নর সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন, পাবলিক এত বোকা কেন? কেন তাঁরা এত উচ্চ সুদে ধার নিতে এনজিওদের কাছে ছুটে যান?
তাঁরা ব্যাংকে যান না কেন? এখানেই কিন্তু আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। গরিব মানুষকে ব্যাংক ঋণ দেয় না। তারা ঋণ দেয় টাকাওয়ালাদের। গরিবদের জন্য তারা সময়-সময় বিশেষ প্রকল্প বানায়। গরিবকে ব্যাংকের ঋণ পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়, ঋণ পেতে নানা রকম লেনদেনের কথাও শোনা যায়। ফলে কাগজে–কলমে অল্প সুদে ঋণ পেলেও প্রকৃত সুদ হয় অনেক বেশি। সে তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সুদে এনজিও ঋণ দেয়। এ জন্য তাঁকে এনজিওর অফিসে যেতে হয় না। ওদের কর্মীরা বাড়িতে এসে তাঁদের হাতে টাকা দিয়ে যায়। গভর্নর সাহেব, আপনি ব্যাংকব্যবস্থার প্রধান। আপনারা থাকতে মানুষ আপনাদের কাছে না গিয়ে এনজিওদের কাছে যান কেন? আপনারা এই সেবাটুকু দিলে তো কেউ আর অন্য জায়গায় যেতেন না। তো আপনারা এই সেবাটুকু দিচ্ছেন না কেন?
প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় অনেকেই অনেক টাকা ঋণ নেন। এখনকার হিসাব আর কোটিতে নেই। এটা হয়ে গেছে শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক জানে কে খেলাপি। জেনেশুনেও তারা চেনা মুখগুলোর কাছে দরাজ হাতে তাদের তহবিলের ডালা খুলে দেয়। আমাদের ব্যাংকব্যবস্থাসহ অর্থ খাতে আছে নানান সমস্যা। এসব সমস্যা তাঁরাই তৈরি করেন, যাঁরা এগুলো চালান।
জিন-ভূত এসে এসব করে দিয়ে যায় না। এ নিয়ে কেউ সরব হলে তাঁর কপালে দুঃখ আছে। আমরা তো ভুলে যাইনি, একসময় একটি প্রতিষ্ঠানের হোমরাচোমরারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের অফিসে গিয়ে কী করেছিলেন? শুধু গায়ে হাত তোলা বাকি ছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। এটা ২০১৭ সালের অক্টোবরের কথা। আমি ‘এক-এগারো’ নিয়ে একটি গবেষণা করছিলাম। সে জন্য দরকার মনে করলাম, আসল লোকদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। তিনি একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকেরও গভর্নর ছিলেন। কথা বলার জন্য আমি গিয়ে হাজির হলাম যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে তাঁর বাসায়। কথায় কথায় তিনি ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য দেন ও মন্তব্য করেন। তাঁকে উদ্ধৃত করছি: ‘দুর্নীতি ছিল একটা বড় সমস্যা। এ জন্য অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে ব্যাংক খাতের সংস্কার ছিল জরুরি। সরকার ওই সময় একটি ব্যাংকে তিন শ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছিল। তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি বরখাস্ত হয়েছিলেন। সরকার নিয়ম চালু করেছিল, কোনো পরিবার থেকে একটি ব্যাংকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না।
কেউ পরপর দুই মেয়াদের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। দরকার হলে দুই মেয়াদের পর এক মেয়াদ বাদ দিয়ে পরে আবার পরিচালক হতে পারবেন। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে ব্যাংকের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্ত্রী বা আত্মীয় পরিচয়ের সুবাদে কেউ কেউ ব্যাংকের পরিচালক হয়ে গেছেন।
নিজে অল্প কিছু টাকা জমা দিয়ে অন্যদের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে ব্যাংক চালু করেন। সেখানে হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা থাকে। মালিক তো ওরাই। কিন্তু এ দেশে ব্যাংক পরিচালকেরা মনে করেন, তাঁরাই ব্যাংকের মালিক।’ (সূত্র: এক-এগারো: বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮, প্রথমা প্রকাশন)।
যে কথা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু তাঁর বক্তব্যে ঊহ্য ছিল, তা হলো, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরনের কাণ্ড ঘটে না। আর ক্ষমতাসীনেরা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে জনগণের সম্পদ নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যেই বিলি-বণ্টন করতে। এ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। ব্যাংকব্যবস্থা চলে গেছে ঋণখেলাপি ও লুটেরাদের হাতে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক