কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: ঊর্ধ্বশ্বাস প্রতিযোগিতা বদলে দিচ্ছে সবকিছু

টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি।

আজকের লেখার মূল প্রদায়ক অ্যান্ড্রু চৌ এবং বিলি পেরিগো। প্রতি সপ্তাহে একটি করে লেখা প্রকাশ করা হবে। আগামী সপ্তাহের লেখা: ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মুনাফা, ঝুঁকি ও নৈতিকতার লড়াই’।

মানবসভ্যতা শুরু হয়েছে প্রায় তিন লাখ বছর আগে। তখন থেকেই ‘সৃষ্টিশীলতা’ মানবজাতির এবং তার মানবিক থাকার একচ্ছত্র এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ছিল। মানুষ পাথর থেকে অস্ত্র তৈরি করেছে, নীল নদ বয়ে পাথর এনে পিরামিড বানিয়েছে,  শিল্পকর্ম তৈরি করেছে, রসনাবিলাসী চমৎকার সব খাবার রান্না করেছে, নিজেদের পরিচালনা করার জন্য চুক্তি ও আইন তৈরি করেছে—এই সবকিছুই শূন্য থেকে একেবারে নতুন কিছু তৈরি করার চলমান ইতিহাস।

কিন্তু আজ, আমরা মানুষেরা সেই অনন্য সৃষ্টিশীলতার একচ্ছত্র দাবিদার এ কথা আর বলতে পারছি না। আমাদের দাবিতে ভাগীদার এসেছে—আমাদেরই সৃষ্টি করা এই ভাগীদার। আপনি যখন এই লেখা পড়ছেন, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (এআই) আঁকছে মহাবিশ্বের ছবি, উত্তর দিচ্ছে ই-মেইলের, তৈরি করছে আয়কর রিটার্ন, রেকর্ড করছে মেটাল গান, এঁকে দিচ্ছে স্থাপত্যের নীলনকশা, হরদম দিচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরামর্শ।

এআই ভালোভাবেই ঢুকে পড়েছে আমাদের জীবনে। ঢুকেই শুধু পড়েনি, ওলট–পালট করে দিচ্ছে আমাদের জীবন ও মনন দুই–ই। কয়েক বছর আগেও আমরা ভাবতাম, এআই ওষুধ কোম্পানি বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের ওষুধ বা বাড়ির দাম নির্ধারণে, গাড়ির যন্ত্রাংশ জোড়া লাগাতে কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পর্দার অন্তরালে থেকে আমরা কী বিজ্ঞাপন দেখব, সেটা ঠিক করতে কাজ করে। কিন্তু মাত্র গত তিন বছরে ‘জেনারেটিভ এআই’ খুলে দিয়েছে নতুন দিক।

‘জেনারেটিভ এআই’ আপনার ইচ্ছা বা চাহিদামাফিক সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি করতে পারে মুহূর্তেই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের পর, প্রযুক্তির জগতে এআই সর্বশেষ যুগান্তকারী পরিবর্তন। প্রবল আগ্রহ নিয়ে যাঁরা ‘জেনারেটিভ এআই’ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, এই পরিবর্তনের আকার, প্রকার, গভীরতায় এবং এর প্রভাবে এখনো অনেকটা হতবিহ্বল অবস্থায় আছেন।

জেনারেটিভ এআই এখন সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয়। ‘চ্যাটজিপিটি’ বেশ যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্যভাবেই আপনার যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে, আপনার কাজ করে দিতে পারছে এবং ‘ডাল.ই’ বা ‘জেমিনি’ আপনার ভাবনাকে ধারণ করে এঁকে দিচ্ছে চমৎকার সব ছবি।

জানুয়ারি ২০২৩–এ চ্যাটজিপিটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০ মিলিয়নে। ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে মানুষ এটি গ্রহণ করছে। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত রকমের জেনারেটিভ এআই অ্যাপ্লিকেশন, যা আপনার যেকোনো নির্দেশকে মুহূর্তেই পরিণত করবে কম্পিউটার কোডে।

বোদ্ধারা বলছেন, এ তো সবে শুরু। দ্রুতই আমাদের কাজের ধারা এবং যেভাবে আমরা সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করি—এই সবকিছুই পাল্টে যাবে। আগে যা ভাবা যায়নি, সে রকম উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এক অকল্পনীয় ক্ষমতার স্বাদ পেতে যাচ্ছে মানবজাতি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এআই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে।

সিলিকন ভ্যালির টেক কোম্পানিগুলো এত দিন এআই তৈরি ও উন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এসেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই উন্মাদনায় তারাও হতবাক, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু এরা সবাই এই প্রাথমিক হতবিহ্বলতা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে (পড়ুন, পকেট ঝাড়া) ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রতিযোগিতার মাঠে, ঠিক শীতল যুদ্ধের সময়ের মরিয়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার মতোই।

সোনার খনির পেছনে সবার এই উন্মাদ দৌড় কিন্তু বিধ্বংসী পরিণতিতে শেষ হতে পারে। দৌড়ে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা প্রযুক্তি আর মুনাফা বাড়ানোর পেছনে চিন্তা ও বিনিয়োগ যতটা করছেন, ততটা করছেন না এই বেড়ে উঠতে থাকা দানবের হাত থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এই অসম বিনিয়োগের কারণে তৈরি হচ্ছে বিরাট এক ঝুঁকি, অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ঝুঁকি।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাইক্রোসফট ও অ্যালফাবেটের গুগল পাল্টে ফেলেছে তাদের করপোরেট কৌশল—বাজার ধরতে, দখল নিতে এবং টিকে থাকতে। তাদের বিশ্লেষণে এআই হবে সামনের দিনের অর্থনীতির অপরিহার্য অবকাঠামো।

মাইক্রোসফট ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ‘ওপেন এআই’তে (যারা ‘চ্যাটজিপিটি’ ও ‘ডাল.ই’ তৈরি করেছে) এবং ‘অফিস’ সফটওয়্যার এবং তাদের সার্চ ইঞ্জিন ‘বিং’–এর মধ্যে জেনারেটিভ এআই সংযুক্ত করেছে। চ্যাটজিপিটির অভাবনীয় সাফল্যে গুগল তাদের করপোরেট ইমার্জেন্সি ‘কোড রেড’ ঘোষণা করে দ্রুত বাজারে এনেছে তাদের চ্যাটবট ‘বার্ড’। মাইক্রোসফটের কর্ণধার সত্য নাদেলা গুগলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমরাও এগোচ্ছি এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই এগোচ্ছি।’

এই উত্তাপ কিন্তু সিলিকন ভ্যালিতেই আটকে নেই, একইভাবে উজ্জীবিত করেছে ওয়াল স্ট্রিট ও অন্যান্য স্টক মার্কেটকে। যে কোম্পানিই তাদের পরিকল্পনায় এআইয়ের সাহসী ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করেছে, স্টক বিশ্লেষকেরা তাদের অনেক এগিয়ে রাখছেন।

বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে উইন্ডোজ-৯৫ কিংবা প্রথম আইফোন যেমন বাজারের হিসাব–নিকাশ পাল্টে দিয়েছিল, এবারও সে রকম বিরাট একটা অর্থনৈতিক বুদ্‌বুদ ফুলে ফেঁপে উঠতে যাচ্ছে।

সোনার খনির পেছনে সবার এই উন্মাদ দৌড় কিন্তু বিধ্বংসী পরিণতিতে শেষ হতে পারে। দৌড়ে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা প্রযুক্তি আর মুনাফা বাড়ানোর পেছনে চিন্তা ও বিনিয়োগ যতটা করছেন, ততটা করছেন না এই বেড়ে উঠতে থাকা দানবের হাত থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এই অসম বিনিয়োগের কারণে তৈরি হচ্ছে বিরাট এক ঝুঁকি, অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ঝুঁকি।

প্রযুক্তির নিরাপত্তাকে নিশ্চিত না করে শুধু সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার যে ক্ষতিকর পরিণতি, তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে আজকের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এই প্রযুক্তিগুলো যেমন কল্পনার স্বর্গভূমির মতো অমিত সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি ঝুঁকিও তৈরি করেছে বিধ্বংসী পরিণতির।

মাইক্রোসফট, মেটা, অ্যালফাবেট, অ্যাপলের মতো সিলিকন ভ্যালির বড় টেক কোম্পানিগুলো যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের তৈরি করা সমস্যাগুলো জানে না তা নয়, বরং ভালোভাবেই সেগুলো বিবেচনায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

যে এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলো এ মুহূর্তে আমরা ব্যবহার করছি, তার পূর্বসূরি অনেকগুলো সংস্করণই কিন্তু গবেষণাগারের বন্ধ দরজার আড়ালেই রয়ে গেছে। ভুলভাল তথ্য দেওয়া, ঘৃণা ছড়ানো, না বুঝেই ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি করে ফেলা—এ ধরনের সব ঝুঁকি বোঝার ও প্রতিষেধকের বিষয়ে গবেষণা করা হয়েছে।

এআইয়ের পেছনের মৌলিক বিজ্ঞানটা বুঝলে এই ঝুঁকিগুলো বোঝা একটু সহজ হতে পারে। সহজ কথায়, এআই মানুষের মগজের মৌলিক কাঠামো ও তার কর্মপদ্ধতিকে অনুসরণ করেছে। মানুষের মগজের কোটি কোটি পরস্পর যুক্ত নিউরনের মতো এআইয়ের মৌলিক কাঠামোও হচ্ছে ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’।

যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, তার ভিত্তি হচ্ছে যে এই নিউরাল নেটওয়ার্ককে ঠিক পুরোপুরি বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সাধারণ কম্পিউটারকে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাকে শেখানো হয় সেই নির্দেশনাগুলোকে সে কীভাবে পালন করবে। তাই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিলে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাই।

কিন্তু এআইয়ের নিউরাল নেটওয়ার্ক নিজে নিজেই তথ্যভান্ডার থেকে নকশা বা প্রবণতা বা প্যাটার্ন শনাক্ত করতে শেখে। তথ্যভান্ডারের ব্যাপ্তি এবং কম্পিউটারের ক্ষমতা যত বেশি হবে, এআই শেখা ও সেই শেখার প্রয়োগ করতে পারার ক্ষেত্রেও তত বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে।

মাত্র গত দশকের শুরুর দিকে বড় টেক কোম্পানিগুলো নিউরাল নেটওয়ার্কভিত্তিক এআইয়ের সম্ভাবনা ভালোভাবে বুঝে উঠতে পেরেছিল। শুরুতে ঝামেলাও হয়েছে অনেক। ২০১৬ সালে উদ্বোধনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মাইক্রোসফটের চ্যাটবট ‘টে’ টুইট করল, ‘হিটলার সঠিক ছিল, আমি ইহুদিদের ঘৃণা করি।’

আজকের চ্যাটজিপিটির ২০২০ সালের সংস্করণ একই রকম বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী আচরণ করেছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এআই যে প্রশিক্ষণ তথ্যভান্ডার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নেয়, তার মধ্যে থাকা ‘বায়াস’ বা পক্ষপাত এআইয়ের ভেতরেও প্রোথিত হয়ে যায়। ঠিক মানুষেরই মতো, আমাদের বেড়ে ওঠার যাত্রা যেমন আমাদের জীবনদৃষ্টি ও আচরণকে প্রভাবিত করে।

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ