ভাগনারের ভবিষ্যৎ যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়েও উজ্জ্বল

পুতিনের সঙ্গে প্রিগোশিন। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন
ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ভাগনারের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিনসহ আরও নয়জন রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রিগোশিনের মৃত্যুর কারণ অজানা থাকলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেসরকারি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দিয়ে তাঁর সহিংস পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রিগোশিনের উত্তরাধিকারদের কীভাবে ব্যবহার করবেন এবং তাঁদের ওপর কীভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন?

পুতিন ও প্রিগোশিনের মধ্যে সম্পর্কের ফাটলের ফলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনায় ভাগনার কিংবা একই ধরনের আধা সামরিক বাহিনীতে ভাঙন তৈরি হয়েছে, সেই নমুনা দেখা যাচ্ছে না।

ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক কোম্পানি বা পিএমসিএস নামে পরিচিত এই বাহিনীগুলোকে চার দশক ধরে রাশিয়া বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের ভীতিকর ও মূর্তমান ক্রীড়নক হিসেবে প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর ভাগনার গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার বদলে পুনর্গঠিত করছেন পুতিন। বিমান দুর্ঘটনাকে স্রেফ ব্যবস্থাপনাগত ভুল হিসেবে উপস্থাপন করছেন তিনি।

প্রিগোশিনের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে ভাগনারপ্রধানকে শুধু ‘একজন প্রতিভাবান ব্যবসায়ী’ বলে উল্লেখ করে পুতিন বলেন, প্রিগোশিন ‘বড় ভুল’ করে ফেলেছিলেন।

রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে মস্কোর বৈশ্বিক প্রভাব পুনরুদ্ধারের কথা বলে আসছে। এই বয়ানের বাস্তব প্রকাশ দেখা যায় বিদেশের মাটিতে প্রাইভেট বাহিনীর কর্মকাণ্ডে। মস্কোর পক্ষে এই চিন্তা থেকে সরে আসার কথা চিন্তা করা অচিন্তনীয়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির রাশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আন্দ্রে কেন্ডাল-টেইলর বলেছেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অথবা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা অথবা অলিগার্কির অধীনে ভাগনার বাহিনীকে ভাগ করে ফেলা হতে পারে। কিন্তু যা–ই করা হোক না কেন, ধার কমবে না।
পুতিন এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন, ‘ভাগনার স্বেচ্ছাসেবক ইউনিটগুলোর’ অন্যান্য আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি সই করা উচিত।

ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা কোম্পানি ভাগনার ছাড়াও ৩৭টি ভাড়াটে ঠিকাদারি সংস্থার সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো আফ্রিকার ১৯টি দেশে এবং এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ১০টি দেশে কাজ করছে। এই গোষ্ঠীগুলো ভাগনারের মতোই প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত। এমনকি তারা বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘাতেও লিপ্ত রয়েছে।

এগুলোর মধ্যে বড় একটি গ্রুপ হলো কনভয়। গত বছর প্রাইভেট এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে সের্গেই অকসয়োনকভ। ক্রিমিয়ায় ক্রেমলিনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রশাসনের প্রধান ছিলেন তিনি। আরেকটি বাহিনী হলো রিডাট। সিরিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের পাহারাদার এই কোম্পানি ২০২২ সালে ইউক্রেন আগ্রাসনের সময় ভাড়াটে সেনাদের পাঠিয়েছিল।

প্রাইভেট সামরিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভাগনার সবচেয়ে বড় ও অগ্রগণ্য। এখন রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি ব্যুরো (কেজিবির পরবর্তী সংস্করণ) ইউক্রেনে যুদ্ধরত ভাগনারের ২৫ হাজার যোদ্ধাকে সেখানে অবস্থানরত অন্যান্য প্রাইভেট বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে দিতে কাজ করছে। আফ্রিকায় থাকা পাঁচ হাজার ভাগনার সেনাকেও এ রকম প্রাইভেট বাহিনীতে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন রুশ গোয়েন্দারা।

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ক্ষেত্রে সেখানকার স্বৈরশাসককে অভ্যুত্থান থেকে সুরক্ষার বিনিময়ে সোনার খনি ২৫ বছরের জন্য ইজারা পেয়েছে ভাগনার। রাশিয়াতেও প্রিগোশিন ক্রেমলিনের সঙ্গে বিশালাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য একসময় খাদ্য রান্না করতেন প্রিগোশিন। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ক্রেমলিন প্রিগোশিনের কোম্পানিকে তিন বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে।

আফ্রিকা মহাদেশে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (দুই হাজার) ভাগনার সেনা আছে। এরপর মালিতে আছে ১ হাজার ৫০০ ভাগনার সেনা। সুদান, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক ও বুরকিনা ফাসোতে আছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ভাগনার বাহিনী।

সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত নাইজারের নতুন সরকার ভাগনার সেনাদের তাদের দেশে যেতে ও ফ্রান্স সেনাদের খালি করে যাওয়া জায়গাগুলোয় অবস্থান নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সম্প্রতি ভাগনার এজেন্টরা ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে নতুন ভাড়াটে যোদ্ধা নিয়োগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাজাখস্তানে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁরা যে পোস্টার ছেপেছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে’ লড়াইয়ে যোগ দিলে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে।

জুন মাসে বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে মধ্য এশিয়ার ৯৩ জন ভাগনার সেনা নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কিরগিজস্তানের ১৯ জন, উজবেকিস্তানের ৩৪ ও তাজিকিস্তানের ৪০ জন রয়েছেন। ভাগনার এজেন্টরা তাজিকিস্তান থেকে নারী কর্মীদেরও নিয়োগ করার চেষ্টা করছেন। রাশিয়াতে স্থাপিত ড্রোন ফ্যাক্টরিতে ইরানি প্রকৌশলীদের সঙ্গে যাতে কাজ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্য থেকেই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কারণ হলো, ইরানিদের ভাষা তাঁরা বুঝতে পারেন।

সোভিয়েত-পরবর্তী অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ায় প্রাইভেট সামরিক কোম্পানির উত্থান। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে রাশিয়া থেকে নিরাপত্তাকর্মীদের ভাড়া করতে শুরু করেন। রেড আর্মির আকার ছোট করে ফেলায় অসংখ্য সেনা বেকার হয়ে পড়েন এবং বেসামরিক খাতে তাঁদের চাকরি ছিল দুষ্প্রাপ্য।

বিদেশে, বিশেষ করে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ও খনিজে পরিপূর্ণ আফ্রিকায় ভাড়াটে নিরাপত্তাকর্মী যারা পাঠাত, তারা রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করত। ২০১৪ সালে ভাগনারের প্রতিষ্ঠা এ ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি। রাজনৈতিক ক্রেতাদের জন্য নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহ না করে ভাগনার প্রতিষ্ঠাতা প্রিগোশিন তাঁদের সঙ্গে সরাসরি নিরাপত্তা চুক্তি করতে শুরু করেন। কর্তৃত্ববাদী শাসক কিংবা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ টাকার জোগান দিতে পারত, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন প্রিগোশিন।

সিরিয়ার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ২০১৮ সালে প্রিগোশিনের যোদ্ধারা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে তেল ও গ্যাসক্ষেত্র মুক্ত করেন। এর বিনিময়ের ৫ বছর ধরে সেখানকার আয়ের ২৫ শতাংশ পান তাঁরা। ভিন্নমতাবলম্বী সিরীয়দের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ২০২০ সালের মধ্যে ভাগনার সিরিয়া থেকে ১৩৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে।

জার্মান কম্পোজার রিচার্ড ভাগনারের নামে ভাগনার গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারকে দুই হাজার সেনা পাঠান প্রিগোশিন। লিবিয়ার পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের উৎখাতের চেষ্টায় যুক্ত ছিলেন হাফতার। এই সেনাদের বেশির ভাগকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে।

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ক্ষেত্রে সেখানকার স্বৈরশাসককে অভ্যুত্থান থেকে সুরক্ষার বিনিময়ে সোনার খনি ২৫ বছরের জন্য ইজারা পেয়েছে ভাগনার। রাশিয়াতেও প্রিগোশিন ক্রেমলিনের সঙ্গে বিশালাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য একসময় খাদ্য রান্না করতেন প্রিগোশিন। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ক্রেমলিন প্রিগোশিনের কোম্পানিকে তিন বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে।

প্রিগোশিন এই টাকা থেকে সেনাদের বড় অঙ্কের বেতন দিতেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইউক্রেনে অবস্থানরত ভাগনার সেনাদের একেকজনকে গড়ে ২ হাজার ৯০০ ডলারের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার সেনারা যে অর্থ আয় করেন, সে তুলনায় এটি অনেক বেশি।

এ বছরে ইউক্রেনে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল, সে সময় একেকজন ভাগনার সেনাকে মাসে ১০ হাজার ডলার বেতন দেওয়া হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারকে ৪৮ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভাগনার সেনাদের একীভূত করা সহজ নয়। পুতিনের রুশ সংস্করণের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে খেলছেন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একসময় তার স্রষ্টার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যায়। পুতিনের ক্ষেত্রে প্রিগোশিন সেটাই করেছেন।

  • ডেনিয়েল উইলিয়ামস দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের পররাষ্ট্র বিষয়ে সংবাদদাতা
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত