এক ভয়ংকর, অভাবিত ও নিষ্ঠুর সময় পার করছি আমরা। সমাধানযোগ্য একটি সমস্যাকে শুধু চরম অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতার দম্ভ, নাগরিকদের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা কীভাবে ভয়ংকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তার চেহারা দেখলাম আমরা গত কয় দিন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে-পরে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য বহু আন্দোলন হয়েছে। স্বৈরাচারের দাপট আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে বারবার, গণতন্ত্রের লড়াই আমাদের শেষও হয়নি। কিন্তু আর কোনো আন্দোলনে এত প্রাণহানি হয়নি। এবারের আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল। এ রকম জনবিদ্রোহের রূপ আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো রক্তাক্ত হয়নি কখনো।
আমাদের সবার চোখের সামনেই তরুণদের ক্রমবিস্তৃত একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভয়ংকর সহিংসতার শিকার হতে থাকল। ১ জুলাই থেকে দেশে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমিতিগুলোই, যাদের অধিকাংশই সরকারের অনুগত বলে পরিচিত। তাদের আন্দোলন ছিল বেতন ও বিমা-সংক্রান্ত দাবি নিয়ে।
ঘটনাক্রমে এই একই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনও নতুন পর্বে প্রবেশ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত অনেকেও সক্রিয় ছিল। ছাত্রলীগ করলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাকা ব্যবস্থা আর কয়জনের হয়? বেশির ভাগকে সেই কাজই খুঁজতে হবে।
দেশে প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখা যায়, কিন্তু প্রাপ্য কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, চাকরি পেতে গেলে ধরাধরি-টাকাপয়সা লাগে, নিয়োগ-বাণিজ্য ভয়াবহ! এক বিসিএস, তা-ও কোটার কারণে প্রবেশাধিকার সীমিত। তার পরিবর্তনের চেষ্টাতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
একদিকে শিক্ষক, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলন নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হতো যে এসব তুচ্ছ বিষয়ে তাদের কান দেওয়ার সময় নেই, তারা ‘উন্নয়ন’ নিয়ে ব্যস্ত! এ রকম দেখতে দেখতে ৬ জুলাই আমি লিখেছিলাম:
‘শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেশের এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে আছে অথচ সরকারের কোনো বিকার নেই। কারণ কী? প্রধান কারণ হতে পারে দুটো।
এক হলো দেশের শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্গে জড়িত মানুষদের প্রতি সরকার কোনো দায়িত্ব বোধ করে না। সে জন্য একদিকে আমরা দেখি অন্যান্য দেশের তুলনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম, শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম, আবার যতটুকু বরাদ্দ তার ব্যয়ের যথেচ্ছাচার।
স্কুলশিক্ষকেরা মাসের পর মাস রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া মানার ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অন্যদিকে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় একের পর এক প্রকল্প আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা খুশি তা-ই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া, বাণিজ্যিকীকরণ।
দ্বিতীয় কারণ হলো সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী চায় না, চায় মাস্তান ও মেরুদণ্ডহীন কিছু প্রাণী। এ কাজে সফলও হয়েছে সরকার। যে জন্য হলে হলে ছাত্রলীগের ত্রাস আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের স্তাবক দুর্নীতির সহযোগী তোতাপাখি শিক্ষকদের দাপট।
‘কিন্তু এখন তো সেই শিক্ষকেরাও আন্দোলনে, সেই শিক্ষার্থীদেরও অনেকে কোটাবিরোধী স্লোগানে শরিক। কেননা, এখন সরাসরি লাথি পড়ছে তাদের ওপর। এগুলো সম্মিলিত স্বার্থের আন্দোলন। সরকার তুড়ি মেরে নিজের দলদাসদের দিয়ে এগুলো উড়িয়ে দিতে পারবে না। শিক্ষকদের দাবি নিয়ে বসতে হবে, কোটা সংস্কারেও অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ১০ শতাংশের বেশি কোটা যৌক্তিক নয়। কোটা নয়, মেধাই যে যোগ্যতার মাপকাঠি, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
দিনের পর দিন পার হয়েছে, শিক্ষার্থীদের শোনানো হয়েছে শুধু হাইকোর্টের কথা। তার পরের কাহিনি আমরা জানি। ন্যায্য এবং বহুদিনের ঝুলিয়ে রাখা একটি দাবি নিয়ে আন্দোলন করার অপরাধে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরকারের কাছ থেকে পেতে হলো ভয়ংকর অপবাদ। তার প্রতিবাদে রাতেই তারা সরব হলো, মিছিল আরও দীর্ঘ হলো। এরপর সরকারের মন্ত্রীর কথামতো ছাত্রলীগ হামলা চালাল, নিজেরা না পেরে আরও সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনল।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেল প্রায় একই চিত্র—সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে হামলাকারী ছাত্রলীগ টিকতে না পেরে পালাচ্ছে, কোথাও কোথাও ফিরছে অন্য কোথাও থেকে বাসভরা সন্ত্রাসী নিয়ে। তাতেও না পেরে পুলিশসহ নানা বাহিনী ঢুকেছে ক্যাম্পাসগুলোয়। বলপ্রয়োগ যত বেড়েছে, প্রতিরোধও তত বেড়েছে, অংশগ্রহণ বেড়েছে।
ঢাকা শহরের বিষাক্ত বাতাস আর শব্দাঘাতের মধ্যেও বেঁচে থাকি, কাজ করি। আর এই জানালা দিয়েই আমার দেখতে হলো হেলিকপ্টার ঘুরে আসছে বারবার আর তার ভেতর থেকে একের পর এক কিছু একটা ফেলা হচ্ছে ও বিকট শব্দ হচ্ছে—আর মানুষের চিৎকার। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সেটাই ঘটল। সেদিন আর কোনো পাখি দেখিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি। ১৫ তারিখের পর এখানে শিক্ষার্থীদের ওপর কয় দিন ধরে কয়েক দফা আক্রমণ হয়েছে। প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে তাদের ভাড়া করে আনা গুন্ডা বাহিনী, এরপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী। উপাচার্যসহ প্রশাসনের লোকজন চোখ-দরজা বন্ধ রেখে এসব হামলা হতে দিয়েছেন। তবে শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শিক্ষকেরা এসবের প্রতিবাদ করেছেন, হামলায় শিক্ষক আহতও হয়েছেন।
একপর্যায়ে টিভিতে কিংবা লাইভে সবাই দেখল, ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলোয় শিক্ষার্থী-শিক্ষক নয়, দখল নিয়ে আছে পুলিশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী। শিক্ষার্থীরা পালিয়ে আছে গাছপালা-জঙ্গলের আড়ালে। মুহুর্মুহু গুলি হচ্ছে। যাদের ক্যাম্পাস, তাদের তাড়াতেই এই ভয়ংকর আয়োজন।
সারা দেশের প্রতিবাদ মিছিলে প্রথমে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, অত্যাচার-অপমান মাত্রাছাড়া হওয়ায় ক্রমে যোগ হয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ। এমনকি একপর্যায়ে স্কুলের ছেলেমেয়েরাও যোগ দেয় মিছিলে। সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। সরকার হার্ডলাইনে যাওয়ার কথা বলার আগে থেকেই চরম পথে এগিয়েছে, তাদের আক্রমণ বাড়তেই থাকে, শিক্ষার্থীরা অবরোধ থেকে কমপ্লিট শাটডাউনে চলে যায়।
রংপুরে নিরস্ত্র একা আবু সাঈদকে যেভাবে বুক লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে, সেটা আমরা অনেকেই প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যক্তি পুলিশের বাড়াবাড়ি। কিন্তু দ্রুতই বুঝলাম, না, নির্দেশই এ রকম। চারদিকে তারই ফলাফল—টপাটপ মানুষ পড়ে মরে যেতে থাকল।
শুধু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নয়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশু, কারখানা থেকে বের হয়ে শ্রমিক, গ্যারেজ থেকে বের হয়ে রিকশাচালক, রাস্তা পার হতে গিয়ে কিশোর, বাসার গেটে বৃদ্ধ নারী—কেউ এই নির্বিচার গুলি থেকে বাঁচেনি। হাসপাতালে পা, হাত, চোখ হারানো মানুষের সংখ্যা অনেক। শুধু ভূমি থেকে নয়, আকাশ থেকেও আক্রমণ এসেছে।
আমার পড়ালেখার ছোট ঘরের জানালাটা বেশ বড়। এই জানালা দিয়ে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। আমার জন্য এটা বড় এক আশ্রয়। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আকাশের দিকে মুখ ফেরাই, আকাশের নানা রং, মৌসুমে তো বটেই; দিনেও কতবার বদলে বদলে যায়, বিশাল আকাশ দুনিয়াটাকে বিশাল করে—মায়াময় করে।
দূরে সবুজের কিছু ছোঁয়ার পাশে আরও দেখি পাখিদের নানা খেলা আর ছোটাছুটি—কবুতর, শালিক, চড়ুই, বুলবুলি, কাক, এমনকি দূরে চিল। তাদের ছটফট কিংবা পরস্পরের কথা-গান চারপাশে প্রাণ এনে দেয়।
ঢাকা শহরের বিষাক্ত বাতাস আর শব্দাঘাতের মধ্যেও বেঁচে থাকি, কাজ করি। আর এই জানালা দিয়েই আমার দেখতে হলো হেলিকপ্টার ঘুরে আসছে বারবার আর তার ভেতর থেকে একের পর এক কিছু একটা ফেলা হচ্ছে ও বিকট শব্দ হচ্ছে—আর মানুষের চিৎকার। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সেটাই ঘটল। সেদিন আর কোনো পাখি দেখিনি।
কল্পনাতীত বলপ্রয়োগ, এই সময়ের তরুণদের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের পাশাপাশি সম্পদ ধ্বংসও হয়েছে তুমুল। অনেক সংবাদমাধ্যম সরকারি ভাষ্য সাজাতে নিহত তরুণ-কিশোর-শিশুদের আড়াল করে গাড়ি ও স্থাপনা ধ্বংসের খবর দিয়ে সময় পার করছে, আর চলছে পাইকারি ধরপাকড়।
মাত্র কয় দিনে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির হিসাব এখনো হয়নি, নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। সর্বজনের অর্থে কেনা গুলি কেন, কীভাবে, কার নির্দেশে এতগুলো মানুষের প্রাণ হরণ করল, হাজার হাজার মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করল, কাদের জন্য দেশের সম্পদ, অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার এত বড় ক্ষতি হলো—এই হিসাব তো হতেই হবে।
আমাদের ইতিহাস তো শুধু মার খাওয়ার নয়, আমাদের ইতিহাস হিসাব নেওয়ার, আমাদের ইতিহাস প্রতিরোধেরও।
● আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক