নতুন শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবসম্মত

প্রায় এক যুগ পর নতুন শিক্ষাক্রমে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবর্তনশীল সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষাক্রমের এই পরিবর্তন অনেকটাই স্বাভাবিক মনে করা যেতে পারে। তবে যে ধারায় গত পাঁচ দশক বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আবর্তিত ছিল, সেই জায়গা থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা জানাচ্ছে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে নান্দনিক ও আনন্দময় করার পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ প্রণয়নের প্রয়াস হাতে নিয়েছে সরকার।

তবে নতুন শিক্ষাক্রম আঁতুড়ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই তৈরি হয়েছে সমালোচনা। পত্রপত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাস্তায় মানববন্ধন-সমাবেশ করে নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধী প্রচারণা লক্ষ করার মতো।

এটি আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পরিবর্তন। যে পরিবর্তনের ফলে হয়তো শিক্ষা পৌঁছাবে নতুন দিগন্তে। তবে বাস্তবতার নিরিখে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও কল্পনাপ্রসূত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।

আমি ১২৪ পৃষ্ঠার জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করেছি। ট্রায়াল অবস্থায় থাকা এমন শিক্ষাক্রম আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে দুই পর্বের আলোচনা করার আগে পাঠক চলুন আমরা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’-এর চুম্বক অংশ নিয়ে আলোচনা করি।

নতুন শিক্ষাক্রম কেন হচ্ছে

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা’র অভিলক্ষ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে, গভীর শিখনের বিষয়ে গুরুত্বে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের অগ্রাধিকার প্রদান করা।

এ ছাড়া খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই শেষ করতে পারে, যাতে করে বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক ফেলানো সম্ভব হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতায় প্রাপ্ত সনদে জীবন-জীবিকার সুযোগ পায়।

যেকোনো দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের মৌলিক উদ্দেশ্যই থাকে মূলত ব্যক্তির মানবিক গুণাবলির সুস্থ বিকাশ, যার মধ্য দিয়ে সে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এবারের শিক্ষাক্রম উন্নয়নে সর্বজনবিদিত দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মনোবিজ্ঞান, বাস্তবসম্মতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রতি অগ্রাধিকারের কথা বলা হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কারিকুলাম প্রণয়নে এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব অনেক আগে থেকে দিয়ে এসেছে। তবে দেরি করে হলেও এবার শিক্ষাক্রমে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি মৌলিক কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমার জানামতে, এবারই জাতীয় শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কমিটি সায়েন্টিফিক আর্টিকেলগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে নতুন শিক্ষাক্রমে ‘শিক্ষা’ মৌলিক বিষয়গুলো আলোচনা করেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তবে ভাষান্তর করতে গিয়ে অনেক বিষয় দুর্বোধ্য করে তুলেছে, যা অনেকের কাছেই শিক্ষাক্রমের যে মৌলিক আপ্রোচ, তা রিচ করতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের ভিত্তি কী

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবারের জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কম্পিট্যান্সি বা যোগ্যতা সামনে আনা হয়েছে। যদিও ‘যোগ্যতা’ শব্দটির চেয়ে আমার কাছে ‘পারদর্শিতা’ বা ‘সক্ষমতা’ শব্দটি বেশ মানানসই ছিল।

সাম্য, মানবিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচারকে সামনে রেখে জাতীয় শিক্ষাক্রমে ‘কম্পিট্যান্সি’ সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, পরিবর্তনশীল পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত সক্ষমতা অর্জন করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা।

যোগ্যতাকে ভিত্তি ধরে, এবারে শিক্ষাক্রমকে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে যোগ্যতার উপাদান হিসেবে এসেছে কিছু জটিল শব্দ, যেমন শিখনক্রম, শিখন-শেখানো কৌশল, শিখন-শেখানো সামগ্রী ও মূল্যায়ন পদ্ধতি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে, ‘যোগ্যতা’ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা সচল হলে একজন শিক্ষার্থী সৎ, উদ্যমী, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন, অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার পরিচয় বহন করে যেমন ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে, তেমনি অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবন করার দক্ষতা অর্জন করবে। ফলে শিক্ষার্থীরা সূক্ষ্ম চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সবার জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

বলা হচ্ছে, শিক্ষাক্রমের পরিকল্পনায় থাকা প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই কম্পিট্যান্সি বেজড এডুকেশন বা সিবিই আয়ত্তের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারণ করে পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন করবে।

এ ছাড়া এই শিক্ষা অনুসরণে শিক্ষার্থীরা যেমন নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হবে, তেমন গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করে বিশ্ব নাগরিকের ভূমিকা পালন করবে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম কীভাবে করা হবে

জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে, প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মূলত ১০টি লার্নিং এরিয়া বা অধ্যয়নক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে।

তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন স্তরে পর্যায়ক্রমে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু, সমাজ ও নাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতি বিষয় জ্ঞান অর্জন করবেন। প্রাক্‌-প্রাথমিক পর্যায়ে কম্বাইন্ড বা সমন্বিত একটি বিষয় থাকলেও প্রাথমিকে আটটি আর মাধ্যমিক স্তরে সুনির্দিষ্টভাবে ১০টি বিষয় পাঠ করতে হবে।

আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মাধ্যমিকে নবম শ্রেণি থেকে ‘বিভাগ’ভিত্তিক পড়াশোনার ইতি ঘটছে। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যবই না পেলেও বিজ্ঞানে ভৌতবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারবে, তেমনি সামাজিক বিজ্ঞানে ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি, ভূগোল বিষয়ে পাঠের সুযোগ পাবে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাকে গিলছিল বেশ। তবে দক্ষ ও চাক্ষুষ জনশক্তি না তৈরি হওয়ায় দিনে দিনে ‘শিক্ষাব্যবস্থায়’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছিল, সেই জায়গায় থেকে বের হয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চাওয়া আমাদের দীর্ঘদিনের। যে শিক্ষাক্রম হবে সময়োপযোগী, যা হবে বাস্তবতার আদলে। নতুন শিক্ষাক্রমে সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেও এই শিক্ষাক্রম এখনো অসম্পন্ন, বিতর্কিত এবং বাস্তবতার নিরিখে হয়নি।

মূল্যায়ন কীভাবে

পরীক্ষাভীতি দূর করার জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে ট্র্যাডিশনাল কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে বলা যেতে পারে, পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা অর্জনের পথে হাঁটছে এবারের জাতীয় শিক্ষাক্রম। অনেকটাই কারিগরি স্টাইলে চলবে পড়াশোনা। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করে নিজেকে আগামী দিনের জীবনযোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করার সুযোগ পাচ্ছে।

স্কুলে মূল্যায়নের জন্য মূলত দুটি ধাপকে বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি হলো শিখনকালীন মূল্যায়ন আর অন্যটি হলো সামষ্টিক মূল্যায়ন। শিখনকালীন মূল্যায়নে পর্যবেক্ষণ, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন, মূল্যায়নে টেকনোলজির (অ্যাপস) ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।

তবে ঠিক কীভাবে এই মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি হবে, তা জানা সম্ভব হয়নি, তেমনি সামষ্টিক মূল্যায়ন বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রূপরেখায় দেওয়া হয়নি।

রূপরেখায় বলা হচ্ছে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে কেবল শিখনকালীন মূল্যায়নে আর চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়নের পাশাপাশি উচ্চ ক্রমানুসারে সামষ্টিক মূল্যায়নে জোর দেওয়া হয়েছে।

দশম শ্রেণিতে একটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ধরা হয়েছে ৫০ শতাংশ করে। অন্যদিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পাঠ্যক্রমের ব্যাখ্যা চলতি রূপরেখাসম্পন্ন থাকলেও এই দুই শ্রেণি শেষে পৃথক পৃথক পাবলিক পরীক্ষায় ৩০ শতাংশ শিখনকালীন আর ৭০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকছে সমন্বিত ফলাফল।

আশা করি এই আলোচনার মধ্যে পাঠকেরা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখাবিষয়ক একটি সম্মুখ ধারণা পাবেন। ফলে পরবর্তী আলোচনা করতে আমার সুবিধা হবে।

আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারকে আমি স্বাগত জানাই। দীর্ঘদিন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার মূল্যায়নের প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। যদিও এই সব জিপিএ ফলাফল আমাদের প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাকে গিলছিল বেশ। তবে দক্ষ ও চাক্ষুষ জনশক্তি না তৈরি হওয়ায় দিনে দিনে ‘শিক্ষাব্যবস্থায়’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছিল, সেই জায়গায় থেকে বের হয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চাওয়া আমাদের দীর্ঘদিনের। যে শিক্ষাক্রম হবে সময়োপযোগী, যা হবে বাস্তবতার আদলে।

নতুন শিক্ষাক্রমে সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেও এই শিক্ষাক্রম এখনো অসম্পন্ন, বিতর্কিত এবং বাস্তবতার নিরিখে হয়নি। শিক্ষাক্রমে ঠিক কোন, কী বিষয়গুলো সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে, সে বিষয়ে আলোচনা করার আগে পাঠক চলুন দেখে আসি, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম কাদের দেখে অনুসরিত হচ্ছে?

কার আদলে বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা?

১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়ার) স্ফুটনিক-১ উপগ্রহ পাঠানোর পর পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। রাশিয়ার থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা দেখল, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়বে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশন ধারণা তৈরি করেছিল। এরপর অনেক সময় কেটে গেছে।

কম সময়ে দক্ষ জনশক্তি গড়তে ২০১৩ সালে আফ্রিকার দেশ হিসেবে কম্পিটেন্স বেইজড এডুকেশন বা সিবিই চালু করে জাম্বিয়া। দুই কোটি মানুষের এই দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রমেও ভিত্তি হিসেবে ছিল সুক্ষ্মচিন্তা, সমস্যা সমাধান, ভাষার ব্যবহার, স্বীয় মূল্যায়ন, সহপাঠীর মূল্যায়ন, দলগতভাবে কাজ, ইনোভেশনের মাধ্যমে জীবনের দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখা।

তারা আমাদের দেশের মতোই একই কাঠামোর ১০-১২টি বিষয় শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে রেখেছে। আর জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি পরীক্ষাও রেখেছে। আফ্রিকারই আর একটি দেশ রুয়ান্ডা ২০১৫ সাল থেকে সেই দেশে পারদর্শিতাভিত্তিক পড়াশোনা চালু করেছে। ক্লাসের মূল্যায়ন ছাড়াও এই দেশ বার্ষিক, জেলাভিত্তিক ও পাবলিক পরীক্ষা সচল রেখেছে।

বাংলাদেশে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের প্রভাব রেখেছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়া সেই দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমের কাঠামোর অনেকাংশ আমাদের শিক্ষাক্রমে ঢুকে পড়েছে। ইউনেসকোর সহযোগিতায় হওয়া এই কারিকুলামে পারদর্শিতানির্ভর মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতিও সচল রয়েছে।

২০২৫ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার লক্ষ্যে তানজেনিয়া ২০১৯ সাল থেকে সেই দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আনে। জাম্বিয়া, কেনিয়ার মতো তারাও এক ধারার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে কম্পিটেন্সি বেইজড ছাড়াও স্কুলের বাইরে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা রেখেছে দেশটি। আমাদের দেশে আগে যেমন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ছিল, সেখানে তারা নির্ধারিত শ্রেণির পড়াশোনা শেষে পরীক্ষা নিচ্ছে। বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ে লিখিত, মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে থাকছে গ্রেডিং সিস্টেম।

যোগ্যতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা কোথায়?

কেনিয়া, জাম্বিয়া কিংবা তানজেনিয়ায় যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, তা নিয়ে সেই দেশগুলোতে সমালোচনা, বিক্ষোভ হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষার এই পরিবর্তন তারা করলেও শিক্ষা উপকরণ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সিবিএই শিক্ষা কাঠামোকে শক্তিশালী করছে। এরপরও এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে রয়েছে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ।

প্রজেক্টনির্ভর কিংবা হাতের কাজ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের প্রসারণ প্রয়োজন। ধরা যাক, একটি কক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীর আসন রয়েছে, এখন এই শিক্ষার্থীদের দলগতভাবে কাজ দিলে কিংবা বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দিলে, তারা শ্রেণিকক্ষে যে আসনে ক্লাস করত, তার চেয়ে বড় জায়গার প্রয়োজন।

কম্পিটেন্সি বেইজড শিক্ষার জন্য শ্রেণিকক্ষের আধুনিকায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেখানে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন কার্ড, কুইজ কিংবা ডিজিটাল বিষয় উপস্থাপনের জন্য সাউন্ড সিস্টেম, মনিটার বা প্রোজেক্টর প্রয়োজন। সেগুলোর সরবরাহ করতে না পারলে এই শিক্ষা ধারা বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

যোগ্যতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কোর পার্ট হলো ‘মূল্যায়ন ব্যবস্থা’। অ্যাসেসমেন্ট ধরন ব্যক্তিভেদেও ভিন্ন যেমন হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নতা থাকবে। যে ব্যক্তি মূল্যায়ন করছে, তার সঠিক প্রশিক্ষণ কিংবা উপকরণ না থাকলে সিবিই কাজে দেবে না।
আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে দুর্বলতা কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতে জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা করব।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com