‘আমি চিকিৎসার অতীত আশাবাদী’—উক্তিটি আমার নয়। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ওপরে সংযোজিত ছবিটি সাফ গেমসে এক বাংলাদেশি নারী ফুটবলারের কিক দেওয়ার দৃশ্যই শুধু নয়। এ ছবিটি অনেক কিছুরই প্রতীক। কালের দেয়ালে বাংলাদেশের যে ইতিহাস লেখা হবে, সেখানে এই ছবি, কেউ না চাইলেও, বাঁধাই করা থাকবে সোনার ফ্রেমে। কারণ, এই ছবি বাঙালির আত্মবিশ্বাসের শিলালিপি হয়ে থেকে যাবে কাল থেকে কালান্তরে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এক দিন আমাকে বলেছিলেন, ‘জাতি হিসেবে আমাদের প্রধান সংকট হলো আত্মবিশ্বাসের অভাব। আমাদের আত্মশক্তির জাগরণ দরকার।’ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে প্রথম বক্তৃতায় শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করলেন আর বললেন, ‘রবি ঠাকুর, তুমি বলেছিলে, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি—দেখে যাও, তোমার বাঙালি মানুষ হয়েছে। বাঙালি তোমার কথাকে ভুল প্রমাণিত করেছে।’ এ কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধুর চোখে ছিল অশ্রুর বন্যা। ৯০-এ এসে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক যখন এসব কথা বলেন, ঠিক-ই বলেন কারণ স্বাধীনতার জন্য মরিয়া বাঙালি ৭১-এ আত্মশক্তির যে জাগরণ ঘটাতে পেরেছিল, মাঝপথে তা, সে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছিল।
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন জাতি হিসেবে আত্মসমালোচনা করে গেছেন। এ রকম আরেকটা কথা তিনি অন্য এক প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বাঙালির নাম থাকে দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতায়।’ এর মানে হলো, দরখাস্তের প্রথম দিকে লিখতে হয় তাঁর নাম, যাঁর কাছে আবেদনটা করা হয় (পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ রাজের প্রতিভূদের কাছেই দরখাস্ত করতে হতো)। সব শেষে থাকে আবেদনকারীর নাম। রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি একটা কেরানির চাকরি পেয়েই সন্তুষ্ট।’ প্রায় একই কথা নজরুলও বলেছেন, ‘বাঙালির বড় দৈন্য আকাঙ্ক্ষায়।’
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথা অবশেষে বাঙালি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং খুব ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষের দিকে অবস্থান নিতে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকেই।
এই খাতে প্রায় ৯০ ভাগই নারী, যা বাংলাদেশে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান সূচক নারীর ক্ষমতায়ন নির্দেশ করে। উন্নয়নের বেশ কিছু সূচকে প্রতিবেশী শক্তিশালী ভারতকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেটে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম ওয়ার্ল্ড কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। পাকিস্তানসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের ক্রিকেট টিমকে একাধিকার পরাজিত করেছি আমরা। ২০০৬ সালে মোহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে ও ব্র্যাকের শাখা কাজ করছে অনেক বছর ধরে।
মাত্র কিছু আগে কিছু নারী ও পুরুষ ছোট পোশাকে আপত্তিসংবলিত বিভিন্ন ধরনের কথা লিখে পোস্টার প্রদর্শন করেছেন বিভিন্ন চত্বরে ও রাজপথে। মহাত্মা গান্ধী লিখেছেন, ‘ধর্ম কোনো পোশাক নয়।’ গান্ধী মনে করতেন, ধর্ম থাকে মানুষের অন্তরে আর ঈশ্বর হলেন অন্তর্যামী অর্থাৎ অন্তরে গমন করতে পারেন তিনি। মানুষ প্রতি মুহূর্তে কী চিন্তা করে, ঈশ্বর তা জানেন। প্রতি মুহূর্তের চিন্তা দিয়েই বিচার হবে ভালোমন্দের, পোশাক দিয়ে নয়। এই শিক্ষাটা পোস্টার প্রদর্শনকারী ওই ভাইবোনেরা পাননি।
আমাদের মেয়েরা যখন শর্টস পরে ট্রফি ছিনিয়ে আনল, তখন প্রায় একই সময়ে ইরানে ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনি ‘ঠিকমতো’ হিজাব পরেনি বলে পুলিশ তাঁকে নির্দয়ভাবে প্রহার করেছে। দুই দিন পর মেয়েটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অথচ ইরান ছিল একদা উদার সংস্কৃতির দেশ। যেমন খুশি পোশাক পরার ও ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের অবাধ অধিকার ছিল ইতিহাসের অংশ। বহু ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ভিন্ন মতের স্বীকৃতি ছিল এই সমাজের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। এই দেশেই জন্ম হয়েছিল জগৎ বিখ্যাত কবি ফেরদৌসী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, জালালউদ্দিন রুমিসহ অসংখ্য কবির। ওমর খৈয়াম তাঁর প্রেমিকাকে সাকি রূপে কল্পনা করেছেন, তরুতলে কাব্য ও পানপাত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আরব বিশ্ব ও পাকিস্তান—দুই ক্ষেত্রেই পতন শুরু হলো, যখনই সেখানে মৌলবাদ জেঁকে বসল। অর্থনীতির মূল সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, মৌলবাদের সঙ্গে অর্থনীতির অদৃশ্য সম্পর্ক আছে। মৌলবাদ অর্থনীতির চাকাকে পেছন দিকে টানে।
কৌশিক বসু প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে এক নিবন্ধে বলেন, শুধু ইসলামি মৌলবাদ নয়, হিন্দু মৌলবাদও ধ্বংস ডেকে আনবে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ভারতের জিডিপি আট শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। হিন্দু মৌলবাদীরা সংখ্যালঘু ও নারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাচ্ছে। ফলে বিজ্ঞান গবেষণা, উচ্চতর শিক্ষা ও ভারতের এত দিনের সব অর্জন ভেস্তে যেতে বসেছে। প্রফেসর বসু পাকিস্তান ও আরব বিশ্বের অতীত ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, খোলাফায়ে রাশেদিন আমলে পুরো অঞ্চলজুড়ে অর্থনীতির উল্লম্ফন ছিল ঈর্ষণীয়, বাণিজ্যনগরী দামেস্ক ও বাগদাদে লোকসমাগমে আকাশ ভারী উঠত। আরব হয়ে উঠেছিল বিশ্বের জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা, আবিষ্কার ও সংস্কৃতির কেন্দ্র।
পাকিস্তানের ইতিহাসও একই সাক্ষ্য দেয়। গোড়ার দিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ভারতের ওপরে ছিল। এটা ঘটেছিল সেই সময় যখন লাহোরের মতো শহরগুলো চিত্রকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বহু সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
আরব বিশ্ব ও পাকিস্তান—দুই ক্ষেত্রেই পতন শুরু হলো, যখনই সেখানে মৌলবাদ জেঁকে বসল। অর্থনীতির মূল সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, মৌলবাদের সঙ্গে অর্থনীতির অদৃশ্য সম্পর্ক আছে। মৌলবাদ অর্থনীতির চাকাকে পেছন দিকে টানে।
নারী ফুটবলে, নারী ক্রিকেটে আমাদের উত্থান ছাড়াও মৌলবাদের আস্ফালনের এই দুঃসময়েও আশাবাদের আরও অনেক কারণ আছে। এক হিন্দু মহিলার কপালের টিপ নিয়ে এক পুলিশ অফিসার বাজে মন্তব্য করায় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তা করার ঘটনায়ও বিভিন্নভাবে তরুণ-তরুণীরা ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে। ছোট পোশাকে আপত্তিসংবলিত পোস্টার প্রদর্শনের বিপরীতে আমাদের মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে।
গ্লাসে অর্ধেক জল থাকলে, একজন আশাবাদী মানুষ যতটুকু পূর্ণ আছে, তার দিকে তাকান আর একজন নৈরাশ্যবাদী মানুষ তাকান শূন্য অংশের দিকে। আমাদের পূর্ণ অংশের দিকেই তাকাতে হবে এবং গ্লাসের ভেতরে জল বৃদ্ধির নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে। গ্লাসের ভেতরে জল বৃদ্ধির কাজটা সম্ভব তারুণ্যের শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়ে আর তার জন্য দরকার তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা এমন শিক্ষায় যার ভিত্তি হবে যুক্তি ও বিজ্ঞান।
বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদের আমার ব্যক্তিগত কারণও আছে। পত্রিকায় কলাম লেখার কারণে আমি প্রচুর ই–মেইল পাই। এদের প্রায় সবাই তরুণ বয়সের-স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁরা আমাকে নিরন্তর লিখে যাওয়ার উৎসাহ দেয়, দেয় সান্ত্বনাও।...‘হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে’—অনেক বড় হয়েও এ কথা শুনেছি, অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে উপহাসের পাত্র হতে হতো...আর ভীষণ রকম মন খারাপ হয়ে যেত’ প্রথম আলোর এক নিবন্ধের মধ্যে এ কথা পড়ে মঞ্জুর আহমদ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আমাকে লিখেছে, ‘প্লিজ মন খারাপ করবেন না’। ‘ভালোবাসা যা পেয়েছি, শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছি’—পড়ে হোমায়রা বিনতে নাসির নামে এক কলেজছাত্রী আমাকে লিখেছে, ‘সাহসের সঙ্গে লিখে যান...আপনার জানা উচিত, আপনার লেখা আমাদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে।’
চোখের জলে লেখা ‘যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’ পড়ে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী, অনি লিখেছে, দাদা, আপনিই তো এক দিন আমাকে বলেছিলেন ‘সূর্যোদয় হবে’। আপনি হতাশ হলে আমরা কোথায় যাব, কার কাছে যাব?
প্রিয় মঞ্জুর, প্রিয় হোমায়রা, প্রিয় অনি—তবে তা–ই হোক। ‘চলো আবার ঘুরে দাঁড়াই। চলো মাটি কাটি, ফসল ফলাই...’
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
nntarun@gmail.com