ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

মতামত

ইরানের কারণে কি গাজার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে

গত শনিবার রাতে ইসরায়েলের ওপর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইরানি হামলা ঠুংঠুং আওয়াজ তুলে শুরু হয়েছিল, যা শেষ হয় প্যানপ্যানানি দিয়ে। কয়েক শ ড্রোন ও ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানার আগেই জাতিসংঘে তেহরানের কূটনীতিক বিবৃতি দিয়ে এই পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ইরান থেকে দ্রুতবেগে নিক্ষিপ্ত এসব অস্ত্রকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইসরায়েলের আকাশেই রুখে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় একটি আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে। কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবরও পাওয়া যায়নি।

তবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ চলাকালে এটা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক পদক্ষেপ। গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিক যাচ্ছিল। একটি জটিল ও চড়াবাজির ছায়ামুষ্টিযুদ্ধে ইসরায়েল ক্রমাগত ইরানের মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করছিল আর ইরান অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এ পাশ থেকে ও পাশ কাটাচ্ছিল কোনো মুষ্টাঘাত করা এড়িয়ে।

এটা ইরানের জন্য কঠিন সময়। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের অবস্থান নিচু হতে থাকা, পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিকভাবে বিব্রত হওয়া ও আরবদের ক্ষোভকে তেহরান উপভোগ করছে।

তুলনামূলক সংযত আচরণের মধ্য দিয়ে ইরান প্রতিবেশীদের কাছ থেকে মূল্যবান সুনাম কুড়িয়েছে যা আংশিকভাবে হলেও দেশটিকে দীর্ঘদিন ধরে একঘরে হয়ে পড়া থেকে বের করে এনেছে। তবে এসব অর্জন ভঙ্গুর। ইরানের শাসকগোষ্ঠী ভালো করেই জানে যে ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ বাধলে তা শুধু তাদের আঞ্চলিক অবস্থানকেই নস্যাৎ করে দেবে না, বরং এতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়বে যা আখেরে তাদের ক্ষমতাচ্যুতির কারণ হতে পারে।

শনিবার রাতের আক্রমণ অবশ্য ইরান ও তার অংশীদারদের জন্য যথেষ্ট ভিডিও ফুটেজ বানিয়ে দিয়েছ, যা তারা তাদের প্রচারণায় বেশ খুশির সঙ্গেই ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু এ মাসের প্রথম দিকেই দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলার পর অপমানের জবাব দিতে ইরানের এই প্রতিক্রিয়া কৌশলগতভাবে তেমন সন্তোষজনক কিছু হয়নি।

ইরান এখন জঙ্গি সহযোগীদের ওপর নির্ভর করার সীমাবদ্ধতা দেখতে পাচ্ছে। এটা শুরু হয়েছিল গাজায় হামাসের (ইসরায়েলের সঙ্গে) বিরাট এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে আর তা ঘটে ইরানের অজ্ঞাতে। ইসরায়েলের প্রচণ্ড আঘাত ইরানের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প মাত্রার আগ্রহের সঙ্গে বহুল আলোচিত ‘প্রতিরোধের অক্ষে’র আগ্রাসী অবস্থানের  ব্যাপক অমিল তুলে ধরেছে।

গত কয়েক মাসে সিরিয়া ও লেবাননে ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একাধিক সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এসবের কোনো পালটা জবাব না দেওয়া ইরানের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বাহিনীকে ভীত করেছে বৈকি!

অবশ্য এখন দায়দায়িত্ব ইসরায়েলে কাঁধে এসে পড়েছে। দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছে, যা জনগণকে আশ্বস্ত করেছে। পাশাপাশি জবাব দেওয়ার জন্য হাতে সময়ও করে দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে এক ‘নজীরবিহীন মাত্রা’য় জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এটা সব যোগ-বিয়োগ শেষে একটি জয় হিসেবেই দাঁড়াচ্ছে। গাজায় নৃশংসতা চালানোর জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে বেড়ে চলা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ার পর এখন ইরানি হামলা তাঁর জন্য পশ্চিমা সমর্থন জোরদার করছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো এটাই যে ‘এই দফা পার পেয়ে গেছে’, ইসরায়েলের এহেন ভাবনা দেশটির ঝুঁকি এড়ানোর মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এটাও সম্ভব যে নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনকে বলবেন, ‘যদি আমাদের ইরানে হামলা চালাতে না দাও, তাহলে গাজার দক্ষিণে রাফায় অভিযান চালাতে বাধা দিয়ো না।’

এতকিছুর মধ্যে গাজার ফিলিস্তিনিরা আরও কোণঠাসা হয়ে গেল। তাদের জন্য যে সক্রিয় সমর্থন গড়ে উঠছিল, ইরানের হামলায় তা দুর্বল হতে পারে, তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও বৃহত্তর মানবিক সহায়তা প্রদানের দাবি বিশ্বমঞ্চে পিছিয়ে পড়তে পারে। অথচ এগুলো বেশ জোরদার হয়ে উঠছিল। ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির সমঝোতা এমনিতেই থমকে আছে, এখন তা স্থগিত হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ইসরায়েলের এই সাফল্য এসেছে ইরানের যথেষ্ট হুঁশিয়ারি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জর্দান ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সহায়তায়। যেসব মিত্রদেশকে ইসরায়েল গত কয়েক মাসে অপমান করে এসেছে, সেই সব দেশের ওপরই যে তার নিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভরশীল, এ ঘটনায় তা ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসক কোনো বড় ধরনের যুদ্ধ চায় না এবং নেতানিয়াহুর রণকৌশল পরিচালনা নিয়ে উদ্বিগ্নও বটে।

আরব নেতারাও স্বল্প মেয়াদে ইরানের চেয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধমান নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাঁরা জানেন যে ইসরায়েল যদি ইরানি সশস্ত্র বাহিনী, সামরিক ঘাঁটি বা পারমাণবিক স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে তেহরান ও তার মিত্রদের বাধ্য করা হবে সব ধরনের সংযত অবস্থান ছুড়ে ফেলতে।

সামরিকভাবে অকার্যকর হওয়ার পরও ইরানি হামলাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হবে ভুল। ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম ইসরায়েল সরাসরি অন্য কোনো দেশ থেকে আক্রমণের মুখে পড়েছে। ইরানও এ থেকে শিক্ষা নেবে। ইরান এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে সে পরোক্ষভাবে বিকল্প শক্তির মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি জবাব দিতে পারে। হামলার পর দেশটি মিশ্র বার্তা দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিরতি দেওয়ার কথা বলেছেন।

আইআরজিসি ‘একটি নতুন সমীকরণ রচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া’র কথা ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাধা দেওয়ার সক্ষমতা সামান্য হলেও ক্ষয় হয়েছে। সে আগাম গোয়েন্দা বার্তা জনসম্মুখে জানান দিয়েও ইরানকে নিবৃত্ত করায় সফল হয়নি।

তবে এতকিছুর মধ্যে গাজার ফিলিস্তিনিরা আরও কোণঠাসা হয়ে গেল। তাদের জন্য যে সক্রিয় সমর্থন গড়ে উঠছিল, ইরানের হামলায় তা দুর্বল হতে পারে, তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও বৃহত্তর মানবিক সহায়তা প্রদানের দাবি বিশ্বমঞ্চে পিছিয়ে পড়তে পারে। অথচ এগুলো বেশ জোরদার হয়ে উঠছিল। ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির সমঝোতা এমনিতেই থমকে আছে, এখন তা স্থগিত হয়ে যেতে পারে। যতক্ষণ ওয়াশিংটন গাজায় যুদ্ধবিরতিকে বিপজ্জনক আঞ্চলিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে, ততক্ষণ পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে।

  • এমিল হোকেয়েম লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয় পরিচালক। লেখাটি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া