সাত তারকার অতিথিশালায় অতিথি হাসিনা কই

আগেকার দিনে এই বঙ্গে রাজাদের হাতিশালায় হাতি থাকত। ঘোড়াশালায় ঘোড়া থাকত। গোশালায় থাকত গরু। শালা কিসিমের বড় কুটুম বা অতিথি থাকত অতিথিশালায়।

রাজা-বাদশাহর যুগ অস্ত গেছে। এখন পাবলিক শাসিত রিপাবলিকের যুগ। এখন দেশ চালায় সরকার। সরকারের মাথায় যিনি থাকেন তাঁর ডাক নাম ‘প্রধানমন্ত্রী’।

৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনা খাতাকলমে ‘প্রধানমন্ত্রী’ থাকলেও আদতে তিনি যে কত বড় ‘রাজা’ ছিলেন, তা একটি অতিথিশালার গল্প পড়ে আরও একবার বুঝতে পারছি।

সেই গল্পে দেখতে পাচ্ছি, তিনি দুই-এক বছর পর এক দুই বেলা গিয়ে একটু ভাতঘুম দেবেন, শুধুমাত্র সে জন্য কর্ণফুলীর টানেল প্রকল্পে সাত তারকা অতিথিশালা বানানো হয়েছে।

সেই অতিথিশালা এখন ফাঁকা পড়ে আছে। এই খবর পড়ে মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তল দিয়ে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বানানো হয়েছে, সেই প্রকল্পের মধ্যে আছে এই অতিথিশালা।

খবর পড়ে জানলাম, শুরুতে অতিথিশালার কোনো আইডিয়া কারও মাথায় ছিল না। কাজ শুরুর পর সে সময়কার যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কাদের কাদের জানি আচমকা মনে হয়েছিল, নদীর তলা দিয়ে এত বড় একটা গর্ত কাটা হবে; বাস ট্রাক ইঁদুরের মতো করে সেই গর্তের এক মাথা দিয়ে ঢুকে আরেক মাথা দিয়ে বের হবে।

এমন আজব জিনিস মুজিবকন্যা মাঝে মধ্যে এসে দেখে গেলে বড় বিনোদন পাবেন। তাঁর চোখের বড় আরাম হবে।

সবাই ভেবে দেখলেন, শেখ হাসিনা যখন ঢাকা থেকে এখানে সুড়ঙ্গ দেখতে আসবেন, তখন তো তিনি এখানকার অতিথি হবেন; আর সেই অতিথিকে ‘সৎকার’ করতে না পারলে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে। অতএব, অতিথিশালা চাই।

আইডিয়াটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হলো। শেখ হাসিনা ‘চমৎকার!’ বলে মত দেওয়ার পর তাতে আর অমত কার থাকতে পারে? তিনি ‘ওকে, ফাইনাল’ বলে ফাইলে সিল মেরে দিলেন।

টানেলের রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন—সব এখানে আছে। আরও আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বানানো একটি জাদুঘর। এসব স্থাপনায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (এসি) বসানো হয়েছে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার।

এরপর টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে পারকি খালের পাশে ৭২ একর জায়গা নেওয়া হলো। সামান্য দূরে নোনা হাওয়ার ছন্দময় দমক দেওয়া সমুদ্রসৈকত।

তো, বানানো হলো পাঁচ হাজার বর্গফুটের সুসজ্জিত একটি বাংলো। জলের মধ্যে কেলি করার জন্য সামনেই সুইমিংপুল।

কমপ্লেক্সটিতে রাজার সঙ্গে আসা ‘পারিষদ দলের’ রেস্ট নেওয়ার জন্য বানানো হলো আরও ৩০টি রেস্টহাউস।

টানেলের রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন—সব এখানে আছে।

আরও আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বানানো একটি জাদুঘর। এসব স্থাপনায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (এসি) বসানো হয়েছে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার।

এই জিনিস বানাতে অর্থাৎ অতিথির ‘সৎকার’ করতে সাড়ে চার শ কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হলো।  

বিলাসবহুল অতিথিশালার সুইমিং পুল।

প্রথমে বলা হয়েছিল, টানেল বানাতে খরচ হবে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।

পরে অতিথি সৎকারসহ নানা খাত দেখিয়ে তিন দফায় খরচ বাড়িয়ে খরচ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়।

শেষমেশ টানেল চালু হলো। অতিথিশালাও বানানো হলো। এরপর অনেক শুভ ক্ষণ গেল। শুভ তিথি গেল। অতিথি এল না।

এখন কোটি কোটি টাকার থালাবাসন, বিছানা বালিশ, চেয়ার টেবিল, ফ্যান, এসি, ব্যায়াম করার মেশিনপত্র, সব পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন লোকসান গুনছে টানেল কর্তৃপক্ষ।

এই টানেলটি দিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন চলবে এবং যে পরিমাণ টোল সরকারের ঘরে জমা পড়বে বলে আমাদের শোনানো হয়েছিল, তা এখন একটি রূপকথার গল্পে পরিণত হয়েছে।

এখন মাসে টোল আদায় হচ্ছে গড়ে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু টানেল দেখাশোনা করা ঠিকাদারের পেছনে খরচ হচ্ছে সাড়ে ১১ কোটি টাকা। প্রতি মাসে গড়ে লোকসান প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা।  

মন্দ লোকেরা এগুলোকে স্রেফ লুটপাট বলছে।

অনেকে বলে, এই সব সাত তারকা অতিথিশালা মার্কা সাত তারকা দুর্নীতির কারণে দেশ দেনায় ডুবেছে।

প্রধানমন্ত্রী নামধারী ‘রাজা’ আর তাঁর পাত্র-মিত্র, সেপাই-সান্ত্রীর বিলাসিতার খরচ জোগাতে প্রজাদের কোমর ভাঙার দশা হয়েছে।

কিন্তু এসব কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না। কারণ দেনায় জর্জরিত দেশের গরিব মানুষের জন্য যাঁর প্রাণ কাঁদে; প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জায়নামাজ খোঁজা ও নিয়মিত তাহাজ্জত নামাজ আদায় করা সেই শেখ হাসিনাকে বহুবার বলতে শুনেছি, দুনিয়াবি লোভ লালসা তাঁকে টানে না। বহুবার তিনি বলেছেন, ‘আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।’

তবে মন্ত্রী এমপিদের হাত ধরে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার খবরের মধ্যে তিনি যেদিন বললেন, ‘আমার কাজের লোকও চার শ কোটি টাকার মালিক’, সেদিন ‘আমি দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে’।

শেখ হাসিনা স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখা অন্য নেতাদের সব অবদান উড়িয়ে দিয়ে যেদিন বললেন, ‘এই দেশটা আমার বাপের। আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছে’; সেদিনও ‘আমি দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে’।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com