৯ জানুয়ারি। ২০০৭। সান ফ্রান্সেসকো শহরের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও মস্কন কনভেনশন সেন্টার কানায় কানায় ভর্তি। পেছনে বিশাল সাদা ব্যাকড্রপ। আলো-আঁধারির আতিশয্য নেই। মঞ্চের ওপর সাদামাটা একটা টেবিল। স্বভাবসুলভ নীল জিনস আর কালো হাইনেক ফুলস্লিভ টি-শার্ট পরে হাজির হলেন স্টিভ জবস।
অ্যাপলের তৎকালীন কর্ণধার। টেবিলের ওপর থেকে কালো কাপড় সরিয়ে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করলেন প্রথম আইফোন। প্রযুক্তির এক নবযুগের সূচনা হলো।
গান শোনা, কথা বলা, ইন্টারনেট—সবকিছু আছে এতে। দৈর্ঘ্য মাত্র সাড়ে তিন ইঞ্চি। তখনকার দিনে অন্য ফোনের স্ক্রিন ছিল ছোট। স্ক্রিনের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে থাকত কিবোর্ড আর নানা ধরনের বোতাম। আইফোনের স্ক্রিন থেকে বোতাম আর কি-বোর্ড উধাও হয়ে গেল। রইল মাত্র একটি বোতাম। অচিরেই প্রযুক্তিতে ঠাসা ব্যবহারবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পেল এই নতুন ফোন। হয়ে উঠল আড়ম্বরহীন, কিন্তু কার্যকর এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বলতে পারেন শিল্পকর্ম। বাহুল্যবর্জিত ডিজাইনের এই ধারা অ্যাপলের অন্য সব পণ্যেও দেখা যায়। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার জোড়াহীন স্টিল থেকে তৈরি। নিপুণ রেখাচিত্র। শুধু পণ্যের ডিজাইন নয়, কোম্পানির সব ধরনের কমিউনিকেশনস, বিজ্ঞাপন—এমনকি মোড়কেও অনাবশ্যক আড়ম্বরহীনতার এই নীতি বৌদ্ধ দর্শনে বিশ্বাসী স্টিভ জবস বেশ কঠোরভাবেই চালু করেছিলেন। সব পণ্যের মোড়কে মাত্র দুই রং। সাদা আর কালো। নিজেও খুব সাধারণ, বাহুল্যবর্জিত জীবন যাপন করতেন। নিজের ঘরে এক বা দুটি আসবাব ছিল। একই রঙের ও ধরনের জিনস আর টি-শার্ট পরতেন।
আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের কথা। নিউরোলজির সব থেকে বড় কনফারেন্সে আমার পেপার পড়তে হবে। রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। বিশ্বের নামকরা সব নিউরোলজিস্ট দর্শকের সারিতে থাকবেন। প্রেজেন্টেশনের খসড়া তৈরি করে, আমার তৎকালীন ম্যানেজার অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইজকে দেখাতে গেলাম। রিচার্ড নামকরা নিউরোলজিস্ট। অক্সফোর্ডের।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জিনিসে ঠাসা, অগোছালো ঘর থেকে স্বল্প আসবাবে সাজানো ঘরে ঘুম ভালো হয়। গবেষণা বলছে বস্তুর আধিক্যহীন বাড়িতে যারা থাকে তাদের সৃজনশীলতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি, দুশ্চিন্তা কম, অধিক মনোযোগী এবং অন্যদের সঙ্গে এদের সম্পর্কও অপেক্ষাকৃত ভালো।
খসড়া দেখে রিচার্ড বললেন, ‘তুমি তোমার জ্ঞানের প্রকাশ করতে যাচ্ছ না। তোমার গবেষণালব্ধ ফলাফল সবাইকে জানাতে যাচ্ছ। জটিল তত্ত্ব বাদ দিয়ে একদম সহজ করে, সংক্ষেপে তোমার গবেষণার ফলাফল সবাইকে বোঝাও। মনে রাখবে, তোমার বক্তব্য ১০ বছরের শিশু না বুঝলে কেউই বুঝবে না।’ কোনো কিছু লেখা আর বলার সময় রিচার্ডের এই কথা সব সময় মনে রাখি।
বিশ্বের একাধিক নামকরা জার্নালে রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করেছি। কঠিন কথা স্বল্প পরিসরে, সহজে বলা লেখকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তথ্য আর তত্ত্বের ভারে জরুরি কথা হারিয়ে যায়। কঠিন কথা সহজে আড়ম্বরহীনভাবে প্রকাশ করার জন্য ওই বিষয়ে অগাধ জ্ঞান আর চর্চার প্রয়োজন হয়।
আইনস্টাইনের সবচেয়ে পরিচিত এবং অন্যতম সেরা কাজ হলো ভর আর শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণ। আপেক্ষিকতার অত্যন্ত জটিল এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ইংরেজি বর্ণমালার মাত্র তিনটি অক্ষর আর দুটি গাণিতিক সংকেতের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেন। এতে বদলে যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা, খুলে দেয় পরমাণু থেকে শক্তি বের করে আনার পথ।
জটিল কিছু সমাধানের জন্য চিন্তার সারল্য দরকার। সারল্য আমাদের চিন্তার গভীরতা, ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দেয়, প্রকাশকে করতলে সর্বজনীন আর কার্যকর।
অনাড়ম্বর বিজ্ঞানচিন্তার আরেকটি উদাহরণ দিই। রিচার্ড ফাইনম্যান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের দিকপাল ছিলেন। কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডাইনামিকসের জটিল সমীকরণ মাত্র চারটি সরলরেখা আর তরঙ্গের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজভাবে সবাইকে বুঝিয়ে গেছেন।
বছর কয়েক আগে ব্রাসেলসে এক রেস্তোরাঁতে খেতে গিয়েছি। দাম নয়, স্বাদের বিচারে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁর তালিকা মিশেলিন স্টারের সনদপ্রাপ্ত। তা-ও আবার একাধিকবার। ঢুকেই রীতিমতো হতভম্ব। সাধারণ কাঠের চেয়ার আর টেবিল। ভিড়ে গমগম করছে। মেনু কার্ড নেই। একটা ছোট ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে তিনটি পদের নাম লেখা।
অধিকাংশ রেস্তোরাঁতেই দেখা যাবে, পাতার পর পাতা খাবারের তালিকা। মাঝেমধ্যে ভাবি, একজন রাঁধুনির পক্ষে কয়েক শ পদের রেসিপি মাথায় রাখা বেশ কঠিন। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখেছি, অধিকাংশ ভালো রেস্তোরাঁ বাহুল্যহীন। মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি পদ। পরিচ্ছন্ন, আড়ম্বরহীন নান্দনিক আসবাব। খাবারের স্বাদ আর পরিবেশনার মানই তাদের আভিজাত্যের মানদণ্ড।
আমাদের জীবনের চারদিকে, ঘরে-বাইরে, অপ্রয়োজনীয় আড়ম্বর আর বাহুল্য। চোখ, কান আর মনের জন্য পীড়াদায়ক। বস্তু বাহুল্যে আমাদের ঘর ভর্তি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গড়পড়তার একটি আমেরিকান বাড়িতে অন্তত তিন লাখ বিভিন্ন ধরনের জিনিস থাকে। তার মধ্যে ২০ শতাংশ কোনো দিনই ব্যবহৃত হয় না। আমাদের পোশাকের কথাই ধরুন। ক্লজেটমেইড নামের এক সংস্থার তথ্যমতে, একজন নারীর অন্তত ১৭০ আর পুরুষের ৯৪ সেট পোশাক থাকে। এই সংখ্যা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তিন গুণ বেশি। মনে রাখবেন, এক জোড়া জিনসের জন্য প্রয়োজনীয় তুলা উৎপাদনে দরকার অন্তত ৮ হাজার লিটার আর জামার জন্য ১ হাজার ৮০০ লিটার পানি।
সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন শহরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের বাড়িঘর হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দৃষ্টিকটু স্থাপত্যের সংখ্যাও অনেক। পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সমন্বয়হীন রং, অনাবশ্যকীয় নির্মাণ বাহুল্য। এই বাহুল্য বর্জন করে খুব ছোট জায়গাতেও প্রতিটি বাড়ি দৃষ্টিনন্দন করা যায়।
গ্রিসের একটি ছোট দ্বীপ সান্তরিনি। কুঁড়েঘরের মতো দেখতে ছোট ছোট বাড়ি। বাইরে মাত্র দুটি রং। সাদা আর নীল। লাখ লাখ মানুষ সারা বছর সেখানে যান এগুলো দেখতে।
সুরুচি হয়তো সামষ্টিক এবং সংক্রামক। জাপানিদের কথা ধরুন। অনাবশ্যকভাবে বর্জন করা তাদের জীবনের অংশ। রবীন্দ্রনাথ তার ‘জাপান-যাত্রী’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি যে বাড়িতে ছিলেন তার বর্ণনায় লিখেছেন ‘এদের বাড়ি জিনিসটা অত্যন্ত অধিক নয়। দেয়াল, জানালা-দরজা যত দূর পরিমিত হতে পারে তাই।
অর্থাৎ বাড়িটা মানুষকে ছাড়িয়ে যায়নি, সম্পূর্ণ তার আয়ত্তের মধ্যে।’ কবির শোবার ঘরে ফুলদানিতে মাত্র একটি ফুল ছিল। ফুল আর পাতাতে ঠাসা নয়। কবি লিখলেন, ‘যা তাদের কাছে রমণীয়, তা তারা অল্প করে দেখে। এরা জানে, অল্প করে না দেখলে পূর্ণপরিমাণে দেখা হয় না।’
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জিনিসে ঠাসা, অগোছালো ঘর থেকে স্বল্প আসবাবে সাজানো ঘরে ঘুম ভালো হয়। গবেষণা বলছে বস্তুর আধিক্যহীন বাড়িতে যারা থাকে তাদের সৃজনশীলতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি, দুশ্চিন্তা কম, অধিক মনোযোগী এবং অন্যদের সঙ্গে এদের সম্পর্কও অপেক্ষাকৃত ভালো।
অনাড়ম্বর আর বাহুল্যবর্জিত জীবনযাপনের অভ্যাস এক দিনে গড়ে উঠবে না। কিন্তু শুরুটা করলে আমাদের চারপাশের ক্ষুদ্র নান্দনিক বহুমাত্রিকতা অনেক বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
Subratabose01@yahoo.com