আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখেছি বাইরে থেকে বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে আনার চল খুব একটা ছিল না। আমার মনে আছে, লেগোজাতীয় কোনো খেলনা আমাদের ছিল না।
তার বদলে ছোট ছোট কিছু ম্যাচবক্স ছিল। সেগুলো দিয়ে আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে শহর, ঘরবাড়ি তৈরি করতাম। এসব খেলনা নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম।
আর এখন তো আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা চলছে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসের সঙ্গে। কীভাবে শিশুদের ডিভাইস থেকে দূরে রাখা যায়, সেই প্রতিযোগিতা চলছে।
এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে গেলে শিশুদের অন্য কোনো উপায়ে ব্যস্ত রাখাটা খুব জরুরি।
আমার মেয়েকে যখন বড় করেছি, তখন তাকে বলতাম, একটা শব্দ বলা তার জন্য নিষিদ্ধ। সেটা হচ্ছে ‘বোরড’। কখনো বলা যাবে না ‘আই অ্যাম বোরড’। তার পরিবর্তে আশপাশে যা কিছু আছে, সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। তখন সে ছবি আঁকা থেকে শুরু করে লেগো নিয়ে, বাড়ির আশপাশে সচরাচর যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করতে থাকে।
ইনইকোয়ালিটি বা অসমতার নানান কারণ রয়েছে, দারিদ্র্য বলি বা বঞ্চনা-বৈষম্য যা–ই বলি—এগুলো আসলে একটা শিশুর জন্মের পর থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে।
তবে এটা যেন না হয়, আমার বাবা দরিদ্র বলে আমিও দরিদ্র থাকব, আমার ছেলেমেয়েরাও দরিদ্র থাকবে। যেটাকে বলা হয়, ইন্টারজেনারেশনাল পভার্টি বা আন্তপ্রজন্মগত দারিদ্র্য।
এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, আর বের হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে শিক্ষা।
শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একদম ছোটবেলা থেকে (তিন বছর বা তারও আগে থেকে হতে পারে) যাকে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট (শৈশবের শুরু থেকে বিকাশ) বলা হয়। সেই সময়টাতে এমন কিছু বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া; যাতে একটি অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুর সঙ্গে একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মধ্যে কোনো বৈষম্য না থাকে।
এই জায়গাটা বৈষম্যহীন করতে গেলে ‘প্লে’ বা খেলাধুলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা বা কগনেটিভ ডেভেলপমেন্ট (উপলব্ধিগত বিকাশ) ঘটে।
এ বিষয়গুলো যদি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না ঘটে থাকে, তাহলে সেই শিশুটি শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়বে। এ কারণে আমরা মনে করি, আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট এবং শিশুর প্রাথমিক শিক্ষায় খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
আশির দশকে ব্র্যাক যখন প্রথমবারের মতো ওয়ানরুম স্কুল মডেল চালু করে, তখন আমাদের একটা বড় ফোকাস বা লক্ষ্য ছিল পাঠ্যক্রম উন্নয়নের দিকে। আমরা এমনভাবে আমাদের কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট (পাঠ্যক্রম প্রস্তুত) করতে চেয়েছিলাম, যেন শিক্ষাটা হয় আনন্দমুখর, ছেলেমেয়েদের যেন জোর করে স্কুলে আনতে না হয়। তারা যেন নিজে থেকেই স্কুলে আসতে চায়। নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তি, নেতৃত্বের বিকাশ—সবকিছু আমাদের পাঠ্যসূচির অপরিহার্য অংশ ছিল। এরপর যখন আরও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা হলো, তখন জানা গেল, আসলে শেখাটা দরকার আরও আগে থেকে।
এরপর আমরা আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্টের জন্য কাজ শুরু করলাম। একটা মডেল তৈরি হলো, যেটাকে আমরা প্লে-ল্যাব বলি।
এ ক্ষেত্রেও একই চিন্তা ছিল, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি ছয় মাস থেকে তিন বছর বয়সীদের জন্য আরেকভাবে কাজ করা। আমাদের প্লে-ল্যাব মডেলের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা ও কগনেটিভ ডেভেলপমেন্টে কাজ করা।
এই কাজটা যদি সঠিক সময়ে না করা হয়, তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের কিছু কোষের বিকাশ ঘটে না। বাচ্চারা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, তার জন্য আমরা প্লে-ল্যাব মডেলটাকে সম্প্রসারণ করি। আমাদের ওই ভালো শিক্ষার সংজ্ঞাটা এখন পরিবর্তন করতে চাইছি।
এ ছাড়া সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নিং বা সামাজিক-সংবেদনশীল শিক্ষা, উপলব্ধিগত বিকাশ, নেতৃত্ব তৈরি ও সফটস স্কিলস; যাকে আমরা একবিংশ শতাব্দীর স্কিলস বা দক্ষতা বলি—এগুলো মুখস্থবিদ্যা দিয়ে হয় না। পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পড়ালেখাকে আমরা সমর্থন করি না।
এটার জন্য দরকার সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা। আর এগুলোর সবকিছুর ভিত তৈরি করে দেয় খেলাধুলা।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের ভাষ্য হলো শিশুরা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে কোনো কিছু সবচেয়ে ভালোভাবে শিখে থাকে। একটি শিশুর সামাজিক, শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও শক্তিশালী ভিত গড়ে দেয় খেলাধুলা।
খেলতে গিয়ে একটি শিশুর অন্য শিশুর সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়, নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা ও ভয়কে জয় করতে শেখে। শিশুরা খেলাধুলা করলে নিরাপদ বোধ করে।
এ ছাড়া খেলাধুলা শিশুদের কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করে—প্রযুক্তি চালিত বর্তমান সময়ে যেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা।
এ কারণে শিশু, তাদের মাতা-পিতা এবং পরিচর্যাকারীদের মধ্যে খেলাধুলার বিষয়ে উৎসাহ তৈরি করতে সরকার ও অন্যান্য অংশীজনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।
খেলাধুলা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার। এরপরও শিশুদের সারা জীবনের দক্ষতা বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকার কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে একটি বিশালসংখ্যক মানুষ জানে না যে জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে খেলাধুলাকে শিশুদের জন্মগত মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের হিসাবে, বিশ্বে এখনো বহু শিশু আছে, যাদের কাছে খেলাধুলার অবসর পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন শিশু খেলাধুলা বা শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ২৫ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪০টির বেশি দেশের সম্মতিতে নতুন একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে প্রতিবছর ১১ জুনকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে’ ঘোষণা করা হয় এবং ২০২৪ সালের ১১ জুন প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হবে।
দিবসটি ঘোষণার মূল লক্ষ্য হলো শিশুদের জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ ও মেধা বিকাশের প্রতি আলোকপাত করা। পাশাপাশি তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
মনে হতে পারে, ৬ এপ্রিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব স্পোর্টস’ থাকার পরও কেন ১১ জুন ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে’ ঘোষণা করা হলো? তার আগে স্পোর্টস ও প্লের পার্থক্যটা জেনে নেওয়া যাক।
স্পোর্টস মূলত একধরনের সংগঠিত ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রিয়াকলাপ, যেগুলো নানা ধরনের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। তা ছাড়া স্পোর্টসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো জয়ের জন্য অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা।
অন্যদিকে প্লে হলো নিছক উপভোগ ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যকলাপ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এতে অংশগ্রহণকারীরা অসংগঠিতভাবে এবং ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে প্লেতে অংশ নিয়ে থাকে।
প্লে মূলত শিশুদের সঙ্গে যুক্ত, যা তাদের বিকাশেরও একটি অপরিহার্য দিক। তবে সব বয়সের মানুষ এতে অংশ নিতে পারেন।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সদস্য দেশ ভিয়েতনাম, এল সালভাদর, বুলগেরিয়া, জ্যামাইকা, কেনিয়া ও লুক্সেমবার্গ ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে’ ঘোষণার জন্য নিজেদের আঞ্চলিক সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় ও ক্যাম্পেইন পরিচালনার নেতৃত্ব দেয়।
এ ছাড়া ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইন্টারন্যাশনাল প্লে অ্যাসোসিয়েশন, রাইট টু প্লে ইন্টারন্যাশনাল ও সিসিম ওয়ার্কশপের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে লেগো গ্রুপ ও লেগো ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে।
আসিফ সালেহ্ উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক