রাশিয়া চায়, প্রতিপক্ষ আলাপ-আলোচনা নয়, একেবারে আত্মসমর্পণ করুক
রাশিয়া চায়, প্রতিপক্ষ আলাপ-আলোচনা নয়, একেবারে আত্মসমর্পণ করুক

মতামত

ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে পথ খোলা আছে

রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান (সাবেক প্রেসিডেন্ট) দিমিত্রি মেদভেদেভ সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেনে অভিযানে রাশিয়া ‘সব লক্ষ্যই অর্জন’ করবে এবং শান্তির জন্য ‘আমাদের শর্ত মানতে হবে’। তাঁর এ বক্তব্য অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো, রাশিয়ার শর্ত কী কী? ইতিহাস বলছে, এর উত্তর খুব কঠিন। আধুনিক কালে যত যুদ্ধে রাশিয়া জড়িয়েছে, তার সব কটিতেই দুটি ধরন দেখা যায়। প্রথমত, সম্পূর্ণ বিজয় (চেচনিয়া অথবা সিরিয়া)। দ্বিতীয়ত, দেশটির অঙ্গচ্ছেদ (২০১৪ সালের আগ্রাসনের সময় জর্জিয়া অথবা ইউক্রেন)।

মেদভেদেভের মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে শর্তের বিষয়টি যখন রাশিয়ার একপক্ষীয়, তখন শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো কিংবা শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ খুবই কম। রাশিয়া চায়, প্রতিপক্ষ আলাপ-আলোচনা নয়, একেবারে আত্মসমর্পণ করুক। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন খুব ভালো করে বিশ্বাস করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধে তাঁর দেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু টুঁটি চেপে ধরতে পারেনি। পশ্চিমাদের অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে ধীর করেছে, কিন্তু থামাতে পারেনি।

রাশিয়া এখন বলছে, তারা ইউক্রেনে তাদের যুদ্ধের লক্ষ্যগুলো বাড়াবে। বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে তাদের অস্ত্রের সরবরাহ বাড়িয়েই চলেছে। এতে করে যুদ্ধ বড় পরিসরে (দুর্ঘটনাবশত অথবা পরিকল্পিত) ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আসন্ন শীত মৌসুমে রাশিয়া ইউরোপকে গ্যাস-সরবরাহ বন্ধের যে হুমকি দিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে দুই পক্ষই পরাজয় না মেনে লড়াই তীব্র করতে চায়।

এ পরিস্থিতিতে নিরাপদ একটা পথ বেরিয়ে আসতে পারে কেবল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু রাশিয়ার কৌশল ও প্রত্যাশা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা না পাওয়ায় সেটা কীভাবে হতে পারে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। কোন কোন শর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজি হবেন পুতিন, তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। হতে পারে ইউক্রেনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় থাকবে না—এমন শর্ত তিনি দিতে পারেন। অথবা রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের যতটুকু ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে, সেটুকুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করতে পারেন। এর বাইরেও তিনি পূর্ব ইউরোপে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত অঞ্চলে নিরস্ত্রীকরণের দাবি তুলতে পারেন।

২০২১ সালে বিশ্বে সামরিক ব্যয় ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা ২০১২ সালের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। পারমাণবিক অস্ত্র আরও বেড়েছে, সেগুলো আরও আধুনিক হয়েছে। সাইবার সংঘাত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। চীন ও পশ্চিমের এবং ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা নতুন নতুন সামরিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। তাতে করে বিশ্বশান্তি সূচক এখন অনেক নিচু পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

পুতিনের চূড়ান্ত মনোভাব যখন জানা যাচ্ছে না, তখন ইউক্রেন ও দেশটির পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের নিজেদের পক্ষের শর্তগুলো ঠিক করা। কোনটা মানা যাবে, কোনটা মানা যাবে না, সেটা ফয়সালা করে ফেলা। যদিও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দেশ ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তির ফয়সালা হবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে। শান্তিপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে গেলে চারটি প্রধান প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। এক. ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারে রাশিয়াকে কি দায়ী করা হবে? দুই. যেসব যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো কি বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা হবে? তিন. ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা কি আগের অবস্থানে অটুট থাকবে, নাকি দেশটিকে দুই ভাগ করে একটি অংশকে রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে প্রস্তাব দিয়েছেন)? চার. আঞ্চলিক নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?

এর মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে চতুর্থ প্রশ্নটির মীমাংসা করা খুব কঠিন। কেননা সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির প্রতি চরম অবহেলা ও অশ্রদ্ধার প্রদর্শন চলছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত রায় দিয়েছিলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া যেন আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত থাকে। কিন্তু মস্কো সেটা উপেক্ষা করেছে। একইভাবে যেসব চুক্তির কারণে ইউরোপে শান্তি বজায় ছিল, সেগুলোও এখন ভীষণভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সেগুলো গড়ে তুলেছিল।

তালিকায় আমাদের আরও একটি এবং শেষ প্রশ্ন যুক্ত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্ন হলো, ধরা যাক ইউক্রেনের ওপর একটা চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হলো, তাতে যে নজির স্থাপিত হবে কিংবা যে অপব্যাখ্যা শুরু হবে, সেটা কি আদৌ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে? এর কোনো একটি প্রশ্নের উত্তরই সহজ নয়। আপস, সহযোগিতা এবং শান্তি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের চেয়ে কঠিন। এখনো অনেকেই পুতিনকে কেন ঠেকানো হচ্ছে না, রাশিয়ার পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি অমূলক—এ ধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু শুধু রাশিয়ার সীমানায় নয়, ন্যাটো এবং বাকি বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় হুমকি তৈরি হয়েছে।

২০২১ সালে বিশ্বে সামরিক ব্যয় ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা ২০১২ সালের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। পারমাণবিক অস্ত্র আরও বেড়েছে, সেগুলো আরও আধুনিক হয়েছে। সাইবার সংঘাত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। চীন ও পশ্চিমের এবং ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা নতুন নতুন সামরিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। তাতে করে বিশ্বশান্তি সূচক এখন অনেক নিচু পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, বৈশ্বিক খাদ্যসংকট, মূল্যস্ফীতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি—সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সঠিক শর্তগুলো খুঁজে বের করে শান্তির অন্বেষাই হবে এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

আলেক্সান্ডার গিলেস্পি নিউজিল্যান্ডের ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক