এই সরকারের দুই মাস হয়ে যাচ্ছে। আর এখনই ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’ রব উঠেছে। উঠবেই না কেন?
আগের যে ‘মাফিয়া’ প্রশাসন রেখে যাওয়া হয়েছে, তা দিয়ে গাড়িকে চালানো সম্ভব না। আর আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত ‘সিস্টেমের ভেতর থেকে সিস্টেম’ ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে এই দেশে কেউ কি খুব ভালো হয়েছে?
সরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই সরকারের প্রথম সমস্যা হচ্ছে উপদেষ্টাদের মধ্যে বিশাল জেনারেশন গ্যাপ।
এই দলে ৬০ বছর বয়সীদের ঊর্ধ্বে যেমন অনেক, আবার ২৫ বছরের নিচের উপদেষ্টাও আছেন। কিন্তু আসলে কাজ করে ৩৫ থেকে ৫০ বছরের মানুষেরা, যারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে তারুণ্যকে সংযুক্ত করে।
বিভিন্ন গবেষণায়ও জীবনের সবচেয়ে দক্ষতার জন্য এই সময়ের কথাই বলা হয়। একমাত্র বিডার চেয়ারম্যান বাদে কোনো জায়গায় এই বয়সী মানুষকে নেওয়া হয়নি। ফলে উপদেষ্টাদের বিশাল অভিজ্ঞতা কর্মে পরিণত করা যাচ্ছে না।
বর্তমান সরকার টেকনোক্রেটিক সরকার। তাত্ত্বিক মতে, এই সরকারের আসল শক্তি ঠিক পজিশনে ঠিক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া। এই সরকারে নেই কোনো প্রকৌশলী। মেগা প্রজেক্টগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানি, কীভাবে সরকারি প্রকৌশলীরা উপর–ফাঁকি দেন। এই জিনিস অন্য কেউ ধরতে পারবে না।
তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডাক্তার ছাড়া অন্য উপদেষ্টা দেওয়ায় এই খাত এখন অনেক অরাজক অবস্থায় আছে।
দেশকে বাঁচিয়ে রাখে কৃষি। এই পরিষদে কোনো কৃষিবিদও নেই। ফলাফল ডিম, ইলিশ আমদানি–রপ্তানির জন্য আমরা আমলাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
সরকার উপদেষ্টাদের অধীনে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে পারে, যার কাজ হবে সংসদীয় কমিটির আদলে। তাহলে অনেক সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাবে।
এরপর আসি অর্থনীতিতে। বিদেশি ঋণ আর সাহায্যে অর্থনীতিতে সুবাতাস দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই ঋণকে কাজে লাগানোর মতো প্রশাসন কি সরকারের হাতে আছে?
পুরো টিমের শুধু একটি কমিটিতে জনাব ফাহিম মাসরুর ছাড়া বেসরকারি খাতের কেউ নেই। কিন্তু দেশের মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত।
এই খাতে কাজ করা দেশে–বিদেশে কিছু চমৎকার মানুষ আছেন, যাঁরা দেশের কর্মপরিকল্পনার স্ট্যান্ডার্ডই বদলে ফেলতে পারেন।
এখন একটি বড় সমস্যা বেকারত্ব। বেকারত্ব কোনোভাবেই সরকার দূর করতে পারবে না। এমনকি মোটামুটি পর্যায়েও কমাতে পারবে না।
এই অবস্থায় বেসরকারি খাত ছাড়া কীভাবে তারা বেকারত্ব কমানোর কথা ভাববে?
সরকারের প্রশাসনব্যবস্থা তাদের বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা সব সময়ে যে সরকারই আসুক সহায়ক পরিবেশ চান। তাই তাঁদের আস্থায় আনা অনেক বেশি সহজ।
বেকারদের জন্য অবৈধ বিদেশি বিতাড়নের মাধ্যমে সাময়িক কিছু চাকরির সুবিধা দেওয়া যায়। তাদের পরীক্ষাপদ্ধতি সহজ-ব্যাংকড্রাফটের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বা অপ্রয়োজনীয় কাগজের স্তূপ দিয়ে আবেদনপত্রের ঝামেলা কমাতে হবে। তাদের জন্য চেষ্টা হচ্ছে—এটি তাদের বোঝানোটা খুব জরুরি।
এ ছাড়া বিদেশি ডেটা সেন্টারগুলোকে দেশে নিয়ে এলে ৫০ মিলিয়ন ডলার রক্ষা করা সম্ভব এবং দেশেই অনেক হাই প্রোফাইল কাজের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
এদিকে তরুণদের আউটসোর্সকে সহজলভ্য করতে পেপল বা পেওনেয়ারকে সহজলভ্য করতে হবে।
এখন নতুন বাজেটের কথা শোনা যাচ্ছে না। সরকার কি আগের বাজেটেই এগোবে? মূল্যস্ফীতি আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা। কিন্তু ১২০ টাকা ডলার ঠিক রেখে নীতি সুদহার বাড়িয়ে কি তা কমানো যাবে? তাত্ত্বিক মতে, তা বেশ কঠিন।
ব্রুগেলের ২৩ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সংখ্যায় এখনকার রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ১৫২ দশমিক ৪৭। এটি কয়েক মাস ধরে কমছে।
কিন্তু কতটা কমবে? এর মধ্যে এখনো সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষজন অস্থির হয়ে উঠছে।
এখন আসি আসল সমস্যায়। সেটি হলো পুলিশ। আমাদের পুলিশ অধস্তনদের কথা শুনছে না তা প্রথম আলোর একটি রিপোর্টেই পরিষ্কার। সরকার কনস্টেবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলেই সামরিক বাহিনী থেকে কম বয়সে অবসরে যাওয়াদের আত্তীকরণ করতে পারে। সঙ্গে স্কাউট বিএনসিসির সদস্যদের দিয়ে কমিউনিটি পুলিশ চালু করতে পারে। পুলিশদের ট্রেনিং বিদেশিদের দিয়ে করালে ভালো হয়, অন্তত তারা শিখতে পারে, কীভাবে মানবিক হতে হয়। এ ছাড়া আনসারদের ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণে দিতে পারে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অনেক দাবি পূরণ হলে ট্রাফিক সিস্টেম সুসংহত হতো।
দুদককে এই দুই মাসে খুব বেশি দেখা যায়নি। এখন তো তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার কথা। তাদের দুর্নীতিবাজ ধরতে হলে বেসরকারি কোম্পানিতে যারা কাজ করছে, তাদের কাছে গেলেই সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে। আবার আগের প্রশাসন, পুলিশ বা আর্মির অনেক লোক এখনো আগের অবস্থানে আছে। তাদের যদি তদন্তের আওতায় আনা না হয়, তাহলে কিছুই করতে পারবে না।
সরকারের কোনো অনলাইন উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ফলে আগের আমলের বটেরা এখন অনলাইনে অবস্থান নিয়ে সরকারের সব কাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষকে হতাশ করার চেষ্টা চলছে।
আগের কালো আইনগুলো এখনো বর্তমান। সেগুলো বাতিল করে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা জরুরি। মানুষের প্রাণের দাবি ‘আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে’ এখনো স্বাক্ষর করা হয়নি।
এভাবে চললে মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই আশা হারাবে। তাদের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
সবশেষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই আন্দোলনের শহীদ এবং আহতদের তালিকা করা। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
আমরা ’৭১–এর মতো খণ্ডিত ইতিহাস আর শুনতে চাই না। ৩০ লাখ শহীদের কোনো তালিকা না হওয়ায় আমরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারিনি, পারিনি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত করতে। এ রকম আর একবার হোক, আমরা চাই না। চাই যথোপযুক্ত শাস্তি। সব খুনি, সব দুর্নীতিগ্রস্তের।
সেনাবাহিনী প্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখানে দুটি চাওয়া, দেশের মানুষ চায় সংস্কার করে নির্বাচন। সরকার যেভাবে শম্বুক গতিতে এবং নরমভাবে চলছে তাতে এখনই মানুষ চিন্তায় পড়ে গেছে এই সরকার সংস্কার করতে পারবে কি না।
এত এত দাবি মানা সম্ভব না এবং সব দাবি মানা তাদের কাজও না। ভুয়া সমন্বয়ক বা অযৌক্তিক দাবিদারদের বিরুদ্ধে মানুষ কঠোরতা দেখতে চাচ্ছে। তাই যারা কাজ করতে চাচ্ছে না, তাদের বাদ দিয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানো যেতেই পারে।
আশার কথা, বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। তাদের মূল নেতাদের কথায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যদিও তাদের প্রান্তিক নেতাদের এই উপলব্ধি এখনো আসেনি।
যদি এই সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের আসলেই শেষ আশা বলে কথাটাও হারিয়ে যাবে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট
ই–মেইল contact@subail.com